একটা গল্প দিয়েই
শুরু করি। কোন
এক দেশে
দুইজন লোকের
মধ্যে খুব
প্রতিযোগিতা লেগে থাকত। এর
মধ্যে একজন
বহুদিন ধরে
গুরুর সেবা-যত্ন করে
জ্ঞান আহরণ
করার পর
অপরজন আর ঠিক
পেরে উঠছিল
না।
তখন সে
তপস্যা করতে
মনস্থ করল। অতঃপর
তাঁর তপস্যায়
প্রীত হয়ে
নেমে এলেন
এক দেবতা। লোকটি
বর চাইল
যে তার
জ্ঞান যেন
তার প্রতিযোগীর
সমান-সমান
হয়।
যথারীতি বর
পূর্ণ হল। এরপর
সে গেল
অপরজনের সাথে
লড়াই করতে। কিন্তু
তবুও নানান
কথার মারপ্যাঁচে
সে আর
পেরে ওঠে
না।
তখন রাগের
বশে দেবতাকে
স্মরণ করে
সে বলতে
লাগল, এ
আমায় কি
জ্ঞান দিলেন
গুরুদেব? আমি
তো ওকে
হারাতে পারছি
না।
সেই দেবতা
তখন হাজির
হয়ে উত্তর
দিলেন, তোমাদের
দু'জনের
জ্ঞান সমান
হতে পারে
কিন্তু অপরজনের
যে জ্ঞানসাধনা
আছে সেটা
তো তোমার
নেই।
তাই তোমার
পক্ষে ওকে
পরাজিত করা
সম্ভব নয়। এই
গল্পের মূল
প্রতিপাদ্য বিষয়টি হচ্ছে যে সাধনা
করে অর্জন
করা জ্ঞান
সর্বদাই শক্তিশালী।
একটা সময় জ্ঞান
আহরণ করা
সত্যিই কঠিন
ব্যাপার ছিল। তখন
জ্ঞান আহরণের
জন্য গুরুর
শিষ্যত্ব গ্রহন
করতে হত। দীর্ঘদিন
ধরে গুরুর
সাথে থেকে,
তাঁর ফাইফরমাশ
খেটে অবশেষে
মিলত জ্ঞানসুধা। অবশ্য
সে জ্ঞানের পরিধিও বিস্তৃত ছিল। তেমনই একজন ছিলেন সঙ্গীতজ্ঞ ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ।
সঙ্গীতের প্রতি ভালবাসা থেকে ঘর ছেড়েছিলেন মাত্র আট বছর বয়সে। বহু গুরুর শিষ্যত্ব গ্রহন
করে একসময় হয়ে উঠেছিলেন মাইহারের মুকুটবিহীন সম্রাট। সেখানে তাঁকে সবাই 'বাবা' বলে
ডাকত। তাঁর হাতে মাইহার ঘরানার শাস্ত্রীয় সঙ্গীত পেয়েছিল এক নতুন রূপ।
ঋত্বিক ঘটক ১৯৬৩ সালে মাইহারে
যান বাবা আলাউদ্দিন খাঁ-র উপর একটি তথ্যচিত্র নির্মান করার জন্য। সেইবার ছিল আলাউদ্দিন
খাঁ-র শতবর্ষ পূর্তির বছর। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের
উপর ঋত্বিক ঘটকের পড়াশুনা করা ছিল, বাহাদুর খাঁ-র কাছে সরোদও শিখতেন। আলাউদ্দিন খাঁ
ঋত্বিক ঘটককে বেশ পছন্দ করতেন এবং তাঁর বাল্যকাল এবং পরবর্তী জীবন সম্পর্কে ঋত্বিককে
বহু গল্প শুনিয়েছিলেন।
ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, জামাতা রবিশংকর এবং ছেলে আলী আকবর খাঁ |
১৯৭৬-৭৭ সালে প্রকাশিত 'জালিম
সিংহের জার্নাল'-এ ঋত্বিক এই স্মৃতিরোমন্থন করেনঃ তখনকার দিনে গণিকারাই গান করত এবং
মঞ্চে নাচ পরিবেশন করত। তাঁর(ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ) বেতন ছিল মাসে পাঁচ রুপি। তিনি
কলকাতার একজন বাঁশীবাদক হিসেবে তাঁর সঙ্গীত জীবনের যাত্রা শুরু করেন এবং পরে উদয়পুরে
যান। তাঁর স্বপ্ন ছিল তানসেন ঘরানার বিখ্যাত সরোদ শিক্ষক ওয়াজির খাঁ-র কাছে সরোদবাদন
শিক্ষা করার, যিনি সেইসময় উদয়পুরে ছিলেন। অনেকভাবে তাঁর দেখা পাওয়ার চেষ্টা করে আলাউদ্দিন
খাঁ ব্যর্থ হলেন। ওয়াজির খাঁ ঘোড়ায় টানা গাড়িতে করে বাড়ি থেকে রাজদরবারে যাওয়া-আসা
করতেন। একদিন আলাউদ্দিন তাঁর পথ রুদ্ধ করলেন। এইসব প্রায় শতবর্ষ আগের কথা এবং তখন ব্যাপারটা
সম্পূর্ণ আলাদা ছিল। সঙ্গীতের জ্ঞান তখন একটা পাহারা দিয়ে রাখা গুপ্ত জিনিসের মত ছিল
যেটা কেউ কারও সাথে ভাগাভাগি করতে চাইত না। অবশেষে এই একগুঁয়ে যুবকের শিষ্য হবার উপর্যুপরি
চাপাচাপিতে পড়ে ওয়াজির খাঁ বললেন, 'আচ্ছা ঠিক আছে, তাহলে তুমি আমার চাকর হও'। আলাউদ্দিন
খাঁ তাঁর বাড়ির টুকিটাকি কাজকর্ম করতেন, যথেষ্ট কষ্টও করতেন এবং মনোযোগ দিয়ে কান খাড়া
করে গুরুর সরোদ বাজানো শুনতেন। কোন বাদ্যযন্ত্র স্পর্শ করার অধিকার তাঁর ছিলনা। দীর্ঘ
দুই বছর এভাবে কেটে যাবার পর ওয়াজির খাঁ তাঁকে শিষ্য হিসেবে গ্রহণ করে নিলেন। তারপর
শুরু হল শিক্ষা। তখনকার দিনে, গুরুর অনুমতি ছাড়া কোন দর্শকদের সামনে সঙ্গীত পরিবেশন
করা যেতনা। দীর্ঘ ১৪ বছরের শিক্ষা শেষে ওয়াজির খাঁ-র কাছ থেকে অনুমতি মিলল। এর স্বল্পকাল
পরে আলাউদ্দিন মাইহারের মহারাজার দরবারে সঙ্গীতজ্ঞ হিসেবে যোগ দেন।
আলাউদ্দিন খাঁ একজন সফল শিক্ষকও
ছিলেন। তাঁর শিষ্যদের মধ্যে বিখ্যাত ছেলে আলী আকবর খাঁ, মেয়ে অন্নপূর্ণা, জামাতা রবিশংকর
এবং আরও অনেকে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে তিনি বেশ কিছু অনাথ ছেলেদের সঙ্গীত শিক্ষা দিয়ে
তাদের নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন বিখ্যাত মাইহার ব্যান্ড।
ঋত্বিকের পরিচালনায় ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ নামের এই গবেষণাধর্মী
তথ্যচিত্রে সমস্ত কিছুই দারুণভাবে প্রদর্শিত হয়েছে। গুরুর সামনে বসে আলী আকবর এবং রবিশংকরের
সঙ্গীত সাধনা কিংবা মাইহার ব্যান্ডের যন্ত্রসঙ্গীত পরিবেশনা এইসব ফুটেজও এখন অমূল্য।
এই বছর অর্থাৎ ২০১৩-তে পূর্ণ
হল এই তথ্যচিত্রের ৫০ বছর। নানান বাধা-বিপর্যয় উপেক্ষা করে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ-র
মত বিরাট মাপের মানুষকে সেলুলয়েডে ধরে রাখার সাহসী প্রচেষ্টার জন্য ঋত্বিক ঘটক একটি
ধন্যবাদ পেতেই পারেন।।
অরিন্দম গুস্তাভো বিশ্বাস
০১ সেপ্টেম্বর ২০১৩
ঢাকা
ঋণস্বীকারঃ
১. ঋত্বিক ― সুরমা ঘটক, অনুষ্টুপ।