পৃষ্ঠাসমূহ

১৪ ফেব, ২০১৪

ভালোবাসার সূর্যরেখা

প্রিয় মুখ নিয়ে যখন ভাবতে বসলাম, তখন একটা সিনেমার সিকুয়েন্সের মতো কিছু ঘটনা আমার চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগল। যেন একটা বায়োগ্রাফিক্যাল মুভি, যার পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে জীবনযুদ্ধ আর হারতে না শেখার শিক্ষা। তাই সেই মুভিটিরই একটা ছোট্ট স্ক্রিপ্টের মতো লেখার চেষ্টা করলাম।

পঞ্চাশ দশকের শেষের দিক। নড়াইলের নলদী জমিদার বাড়ি। একটা বড় খাটের একপাশে বালিশে হেলান দেয়া একজন যুবতী। পাশের টেবিলটায় বেশ কিছু ওষুধের শিশি। খাটের অন্যপাশে ঘুমাচ্ছে তার দুটি ছেলে। একজন কিছুটা বড়, বয়স দুই-তিন বছর হবে, অন্যজন আরও ছোট, দুধের শিশু। সে ঘাড় ঘুরিয়ে তার ছেলেদের দিকে তাকায়, তার চোখেমুখে ফুটে ওঠে দুশ্চিন্তার ছাপ। সে টের পায় তার সময় ফুরিয়ে আসছে দ্রুত। পাশে রাখা কাগজ-কলম টেনে নেয় সে। খুলনায় তার শাশুড়িই এখন তার শেষ ভরসা। কাঁপা হাতে সে লিখতে থাকে – ‘মা, আমি না থাকলে আপনার আদরের নাতিদের ওরা বিলিয়ে দেবে। আপনি যত তাড়াতাড়ি পারেন এসে আপনার নাতিদের নিয়ে যান...।’

কয়েক মাস পরের কথা। যশোরের ফাতেমা হসপিটালের বারান্দায় বসে আছেন সাদা শাড়ি পরা ৫০ ছুঁইছুঁই এক ভদ্রমহিলা। তিনি ভাবেন, আমার বৌমা তো আমাকে এত বড় দায়িত্ব দিয়ে চলে গেল, এখন এই ছোট্ট শিশু দুটোকে আমি কিভাবে আগলে রাখব?

একজন মিশনারি ভদ্রমহিলাকে প্রস্তাব দিলেন, আপনি ছেলেটাকে যশোরে আমার কাছে দিয়ে যান, আমি ওকে লেখাপড়া শেখাবার বন্দোবস্ত করব। ভদ্রমহিলা ভাবলেন, ছোট নাতিটাকে তো আমি রক্ষা করতে পারিনি, বড় নাতিটাকে মানুষ করতে হবে। আবেগের বশে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করলেন না তিনি। নাতিকে নিয়ে যশোরে গেলেন। তারপর আসার আগে আগে তার হাতে কিছু সিকি আধুলি দিলেন। ছেলেটা সেগুলো নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলে পর তিনি তাকে রেখে চুপিচুপি পালিয়ে খুলনা চলে গেলেন।

সাতক্ষীরাতে একটা মিশনারি এতিমখানা। বড় ছেলেটা এখন এখানেই থাকে, তার নাম অপু। এতিমখানার নতুন বিল্ডিং এর জন্য নৌকায় করে ইট-বালি নিয়ে আসা হয়েছে। অন্য সব ছেলেদের সঙ্গে অপুও নদীর ঘাট থেকে মাথায় করে সেই ইট বয়ে নিয়ে আসছে। তার মাথায় একটা গামছা পেঁচানো। একজন ফাদার বললেন, এই তোমরা এদিকে আস তো, একটা ছবি তুলব। অপু আর অন্য একটি ছেলে কিছু বিক্ষিপ্তভাবে ছড়ানো ইটের পাশেই মাথায় গামছা আর মুখে হাসি নিয়ে বসে পড়ল। উঠল ছবি, ফিল্মে বন্দি হলো একটি মুহূর্ত।

একদিন ভোরবেলা পান্তাভাতের সঙ্গে গুড় দিয়ে নাস্তা খাওয়া হবে। কয়েকজন এসে ফাদারকে জানাল যে, গুড়ের ঠিলার মধ্যে একটা বড় ইঁদুর মরে ফুলে আছে। এখন কি করণীয়? ফাদার বললেন, সেটাকে তুলে ফেলে দাও আর গুড়টা সবাইকে খেতে দাও। তাই করা হলো। এই গুড় খাওয়াদের দল থেকে অপুও বাদ পড়ল না। নলদী জমিদার বাড়ির সম্মান এতে ক্ষুন্ন হয়েছিল কি না আমার জানা নেই, তবে এটাই ছিল সেদিনের বাস্তবতা।

আমার ভাবতে গর্ব হয় যে, এতিমখানায় বেড়ে ওঠা জমিদার বাড়ির ওই বড় ছেলেটা আমার বাবা, যিনি কিনা চরম শূন্য থেকে জীবন শুরু করে নিজের সততা ও মেধা দিয়ে সেই জীবনটাকেই জয় করে নিয়েছেন। যিনি অনেক কষ্ট করে বড় হয়েছেন কিন্তু তার ছেলেমেয়েকে কোনোদিনই বুঝতে দেননি যে কষ্ট কাকে বলে। বাবা যখন মাঝে মাঝে তার ছোটবেলার গল্প করেন তখন অনেক সময় আমার সেগুলোকে নিছকই গল্প বলে মনে হয়। আমি ভাবি, ওই অবস্থা থেকে একটা মানুষ কিভাবে এত বড় হতে পারে? এটাও কি সম্ভব? সম্ভব হলেও সেই পথ কতটাই না কঠিন! আমি সাড়ে তিন বছরের একটা ছেলের এতিম হয়ে যাওয়াটা অনুভব করার চেষ্টা করি, কল্পনা করে দেখার চেষ্টা করি ম্যাট্রিক পরীক্ষার আগের রাতে কেরোসিনের অভাবে পড়তে না পারার দৃশ্যটা। আমার আর দেখা হয়ে ওঠে না, চোখের জলে ঝাপসা হয়ে আসে কল্পনাগুলো।

আমার বাবাই আমার প্রিয় মুখ, ভালোবাসার শ্রদ্ধায় আর জীবনের পথ চলাতে। আমার জীবনে যখনই কোনো কঠিন সময় আসে, আমি তখন নিজেকে বাবার পাশে দাঁড় করিয়ে তুলনা করি। কিছুক্ষণ পরেই আমার মনে হয় যে, আমার সমস্যাগুলো আসলে কোনো সমস্যাই না। আমার বাবা এমনই একজন মানুষ।

১৪ ফেব্রুয়ারি এই মানুষটার জন্মদিন। প্রকৃতি এই মানুষটাকে অনেক ভালোবাসার মধ্য দিয়ে সৃষ্টি করে অনেক ভালোবাসা দিয়ে বড় করেছিল। যেন সে মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে সেই মানুষকেই ভালোবেসে যেতে পারে আজীবন। তাই বুঝি মানুষকে সেবা করার ব্রতটাই তার পেশা, আর এমন একটা দিনেই তার জন্মদিন। শুভ জন্মদিন বাবা।।


অরিন্দম গুস্তাভো বিশ্বাস
৩০-৩১ জানুয়ারী ২০১২
ঢাকা