তোমাকে নিয়ে কিছু বলতে গেলেই
অনেক কিছু বলতে ইচ্ছা করে। কিন্তু আমি হচ্ছি দরিদ্র জেলে আর বড়ই ছোট্ট আমার নৌকা আর
জাল। সাগরসম তোমাকে কাগজবন্ধী করার ক্ষমতা আমার ক্ষুদ্র কলমের নেই। তাই ছোট্ট জাল ফেলে
তুলে নিয়ে আসি গুটিকতক মাছ। সেই মাছের মধ্যেই লুকিয়ে থাকে আমার সাগরকে ছোঁয়ার স্বপ্ন।
ছোটবেলায় তুমি যে গল্পটা বলতে
সেটা আরেকবার শোনা যাক। কোন এক ছেলেকে তার মা অনেক ভালবাসতেন। কিন্তু সে তার মায়ের
অত্যন্ত অবাধ্য ছিল। একদিন ছেলেটি এক ডাইনির খপ্পড়ে পড়ে। খুব সম্ভব এই ছেলেটি ডাইনিকে
বিয়ে করতে চায়। তখন এই ডাইনি শর্ত দেয় যে তাকে বিয়ে করতে হলে ছেলেটিকে তার মায়ের হৃদয়
এনে দিতে হবে। তখন ছেলেটি দৌড়ে যায় তার মায়ের কাছে, মায়ের কোন কথাই সে শুনতে চায় না।
শেষ পর্যন্ত তার মা নিজের হৃদয়টি কেটে ছেলেটিকে দেন। সেটাকে নিয়ে ছেলেটি দৌড়াতে দৌড়াতে
ফিরতে থাকে ডাইনির কাছে। পথিমধ্যে হঠাৎ করে হোঁচট খেয়ে পড়ে যায় ছেলেটি। হাত থেকে হৃদয়টি
ছিটকে দূরে গিয়ে পড়ে। মায়ের স্নেহেভরা হৃদয় তখন বলে ওঠে― 'আহারে বাবা, ব্যাথা পেলি?'
এই গল্পটা বারবার শুনতে শুনতে আমি নিজেকেই
এই অবাধ্য ছেলেটি ভেবে নিয়েছিলাম। প্রত্যেকটি ব্যাপারে আমার মনে হত যে আমি তোমার হৃদয়
কেটে নিয়ে চলে যাচ্ছি। এটা ছিল আমার ছেলেবেলার সবচেয়ে যন্ত্রণাময় সময়গুলোর একটা।
এই যন্ত্রণা থেকে আমাকে মুক্তি
দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ডাইনির গল্পকে পেছনে ফেলে এক ঝটকায় তিনি আমাকে বানিয়ে দিয়েছিলেন
ছোট্ট এক বীরপুরুষঃ
তুমি বললে, ‘যাস
না খোকা
ওরে’
আমি বলি,
‘দেখো না
চুপ করে।’
ছুটিয়ে ঘোড়া গেলেম
তাদের মাঝে,
ঢাল তলোয়ার ঝন্ঝনিয়ে বাজে
কী ভয়ানক লড়াই
হল মা
যে,
শুনে তোমার
গায়ে দেবে
কাঁটা।
কত লোক যে
পালিয়ে গেল
ভয়ে,
কত লোকের
মাথা পড়ল
কাটা।
এত লোকের সঙ্গে
লড়াই করে
ভাবছ খোকা
গেলই বুঝি
মরে।
আমি তখন রক্ত
মেখে ঘেমে
বলছি এসে, ‘লড়াই
গেছে থেমে’,
তুমি শুনে পালকি
থেকে নেমে
চুমো খেয়ে
নিচ্ছ আমায়
কোলে -
বলছ, ‘ভাগ্যে খোকা
সঙ্গে ছিল!
কী দুর্দশাই
হত তা
না হলে।’
এই ছোট্ট বীরপুরুষ আর কোনদিন
ডাইনির ভয় পায়নি। কিন্তু আরও বড় হবার পর আমি আরেকটি সত্যি ঘটনা পড়ি। সেই ঘটনা দিয়েই
হয়ত আমি মা'র ভালবাসার আসল অর্থ বোঝা শুরু করি।
আমাদের যশোরের মধুকবি, মাইকেল
মধুসূদন দত্ত। বাবা-মা'র অবাধ্য হতে মনেহয় কিছুই বাদ রাখেননি। ধর্মত্যাগ করার পর বাবা
রাজনারায়ণ বসু কবিকে ত্যাজ্যপুত্র ঘোষণা করেন। অনেক পরে একটা সময় প্রচন্ড অর্থাভাবে
মধুসূদন বাড়িতে ফিরে এসেছিলেন। বাবা তাকে বাড়িতে ঢুকতে দেননি। জাহ্নবী দেবী দৌড়ে গিয়েছিলেন,
স্বামীকে অনুনয় করেছিলেন। অবশেষে অনুমতি পেয়ে চাকরকে দিয়ে কবিকে ডাকতে পাঠান। কিন্তু
ততক্ষণে অনেক দেরী হয়ে গেছে। অভিমানী মধুকবি কপোতাক্ষের সেই ঘাট থেকেই ফিরে চলে গেছেন
বহুদূর। মা'র সাথে কবির সম্ভবত আর দেখা হয়নি। সেই ছোটবেলায় এই ঘটনার বাস্তবতা বোঝার
ক্ষমতা আমার ছিল না। কিন্তু আমার বারবার মনে হত, মধুকবি কেন আরেকটু বেশী সময় অপেক্ষা
করলেন না! তাঁর এই অভিমানের জন্য মা কি কষ্টটাই না পেলেন! মা তো তাঁকে ফিরিয়ে দেবেন
না কোনদিন!
মা'কে নিয়ে যে অনুভূতি আমি
তখন পেয়েছিলাম, অনেক বছর কেটে যাওয়ার পরে বড়বেলার সেই একই অনুভূতি আমি খুঁজে পেয়েছিলাম
হুমায়ুন আজাদের একটা কবিতাতে। বড়বেলার এই অনুভূতি অতি ভয়ংকর, শিরদাঁড়ায় শীতল স্রোত
বইয়ে দেয়। বড় হয়ে গেছি এই জিনিসটাকে ঘৃণা হতে থাকে, আবার ছোট্ট হতে ইচ্ছা করে।
আমাদের মা আর
বনফুলের পাপড়ি
নয়, সারাদিন
ঝরে ঝরে
পড়েনা
আমাদের মা আর
ধানখেত নয়,
সোনা হয়ে
বিছিয়ে থাকে
না
আমাদের মা আর
দুধভাত নয়,
আমরা আর
দুধভাত পছন্দ
করিনা
আমাদের মা আর
ছোট্ট পুকুর
নয়, পুকুরে
সাঁতার কাটতে
আমরা কবে
ভুলে গেছি।
কিন্তু আমাদের মা
আজো অশ্রুবিন্দু,
গ্রাম থেকে
নগর পর্যন্ত
আমাদের মা আজো
টলমল করে।
আম্মু, তুমি বিশ্বাস কর, আমি
তোমাকে অনেক ভালবাসি। শুধু এই বড় হয়ে যাওয়াতে কেমন জানি আর বলে উঠতে পারি না। ছোট্টবেলার
মত বোনের সাথে পাল্লা দিয়ে তোমাকে ছোঁয়ার দৌড়ে অংশ নিতে ইচ্ছা করে। কিন্তু সময়গুলো
কেমন যেন ঢেকে যায় অদ্ভুত কুয়াশায়! আমি পথ হারিয়ে ফেলি।
গতকাল একটা গল্প পড়লাম। নিকোলাই
গোগোলের 'দ্য ওভারকোট'। এই গল্পটা খুব বিখ্যাত একটা গল্প। গোগোলের এই গল্পটির প্রভাব
রাশান সাহিত্যের উপরে এতই বেশী যে ফিওদর দস্তয়ভস্কি বলেছিলেন― We all come out from Gogol's
'Overcoat'. মানে গোগোল যদি ওভারকোট গল্পটা না লিখতেন তাহলে রাশান ভাষায় আর এমন দারুণ
দারুণ সব সাহিত্যিকের আবির্ভাব হত না।
আম্মু, তুমি কি জান যে তুমিও
সেই ওভারকোটের মত? তুমি না থাকলে এই পৃথিবীতে আমার আবির্ভাব হত না। সেই তোমার আজ জন্মদিন।
The Earth was blessed today as you came here.
Happy Birthday Ammu!
তোমার প্রথম শয়তান :p
অরিন্দম
২৩ জুলাই ২০১৩
ঢাকা