পৃষ্ঠাসমূহ

২ সেপ, ২০১৩

মিথলজিক্যাল মিথিলা

অফিস থেকে তড়িঘড়ি করে বের হয় রঞ্জন। তাড়াহুড়া করতে গেলে সমসময় তার কিছু না কিছু একটা ভুল হয়। সেটা সময়মত মনে আসে না। মনে আসে পরে। রঞ্জন খুব খুঁতখুঁতে টাইপের মানুষ। প্রতিটা জিনিস মনের মত না হলে তার শান্তি হয় না। আজকে আবার একটা বিশেষ দিন। এইসব দিনেই এমন ভুলগুলো বেশী করে হয়। রঞ্জন অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে ভাবতে থাকে। কলম, মোবাইল, ওয়ালেট সবকিছু পকেটেই আছে। তবুও রঞ্জনের মনের ভেতরটা খচখচ করে। হঠাৎ তার মনে পড়ে যায়, আইডি কার্ড! সেটা সে ফেলে এসেছে টেবিলের উপর। উফফ্‌! নিজের উপরে নিজেরই রাগ হয় রঞ্জনের। এখন এই আইডি কার্ড আনতে গিয়ে বসের সাথে দেখা হয়ে গেলে পড়তে হবে আরেক ঝামেলায়। তবু তাকে যেতেই হবে, আজকের দিনে এমন ভুল করা চলবে না। গুটিগুটি পায়ে রঞ্জন আবার অফিসে ঢোকে। জোর পায়ে হেঁটে বসের রুমটা পার হয়ে যায়। টেবিলের উপর থেকে কার্ডটা ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে প্রায় দৌড়ে বেরিয়ে আসে বাইরে।

বাসস্টপে প্রচন্ড ভিড়। রঞ্জন লাইনে দাঁড়িয়ে ঘড়ি দেখতে থাকে বারবার। সময়টা যেন পাগলা ঘোড়া হয়ে ছুটছে। বাসটা  আজ আর আসতেই চায় না। পাশে বাস কাউন্টারে কোন যাত্রীর সাথে ঝগড়া বেঁধে গেছে এক টিকেট বিক্রেতার। শীর্ণ কিছু শিশুর হাতে মালা হয়ে ঝুলতে থাকা বকুল ফুলগুলোকে কেমন যেন ক্লান্ত বলে মনে হয়। পেছনের ট্রেনলাইন দিয়ে হুইসেল বাজিয়ে সশব্দে ছুটে যায় কোন দূরপাল্লার ট্রেন। এসব কোন কিছুতেই রঞ্জনের এতটুকু ভ্রুক্ষেপ নেই। এত মানুষের ভিড়ে সে যেন একলা দাঁড়িয়ে থাকে, বিচরণ করে কোন অন্য জগতে। অবশেষে একসময় প্রতীক্ষার সমাপ্তি ঘটিয়ে বাস আসে। রঞ্জন অভ্যাসমত উঠে যায়। বাসে বসেও সেই একই চিন্তায় বিভোর হয়ে থাকে সে। হয়ত অন্ধকার দূর্গে খুঁজতে থাকে কোন বন্দিনী রাজকন্যাকে।

কিছুদিন আগের কথা। কোন কারণে প্রচন্ড মন খারাপ করে বসে ছিল রঞ্জন। মন খারাপের কথা কাউকে শেয়ার করতে পারেনা সে, নিজের ভেতর নিজেই কষ্ট পেতে থাকে। ঠিক এমনই এক কষ্টকর মুহূর্তে, হঠাৎ করেই ফেসবুকে আসে এক অচেনা মেয়ের ফ্রেন্ড রিক্যুয়েষ্ট। মেয়েটির নাম মিথলজিক্যাল মিথিলা। কিছু না ভেবেই রিক্যুয়েষ্ট এক্সেপ্ট করে ফেলে রঞ্জন। প্রায় সাথে সাথেই মেয়েটি নক করে চ্যাটবক্সে। হাই-হেল্লো দিয়ে কথা শুরু হয়। রঞ্জন প্রথম প্রথম একটু সংকোচ বোধ করলেও মেয়েটির স্বাচ্ছন্দ্য কথাবার্তায় সেটা কেটে যায় অল্পসময়ের মধ্যেই। কথা চলে অনেক রাত পর্যন্ত। এরপর কিছুদিন এইভাবে চলার পর আস্তে আস্তে এটা কেমন যেন রুটিন হয়ে দাঁড়ায়। রঞ্জন অফিস থেকে ফিরতে ফিরতেই মিথিলা চলে আসে অনলাইনে। গভীর রাত পর্যন্ত কথা হয় দু'জনের। কিছুটা হাসি-ঠাট্টা, খুনসুটি, কিছুটা গুরুগম্ভীর আলাপচারিতা। এইভাবেই কাটছিল সময়গুলো। কিন্তু গতকাল ঘটল সেই ঘটনা। মিথিলা হঠাৎ করে বলে যে রঞ্জনের সাথে তার কি একটা সিরিয়াস কথা আছে। ওর সাথে মিথিলার কি এমন কথা থাকতে পারে যেটাকে 'সিরিয়াস' ট্যাগ লাগিয়ে বলতে হবে সেটা রঞ্জন ভেবে পায়না। তাই সে কিছুটা বিভ্রান্ত হয়, কি কথা সেটা জানতে চায়। কিন্তু মিথিলা রহস্যময় গলায় বলে যে কথাটা আগামীকাল বলবে। এই বিষয় নিয়ে তখন থেকেই মনের মাঝে উথাল-পাথাল শুরু হয়েছে রঞ্জনের। এখনও একইভাবে চলছে। মনের ভেতর কিছু অদ্ভুত আবেগ-অনুভূতি কাজ করলেও রঞ্জনের সেগুলোকে বেশী পাত্তা দিতে চাইছে না, আবার পাত্তা না দিয়েও থাকতে পারছে না। মিথিলার সিরিয়াস কথাটা আজকে কি হতে পারে সেটা নিয়েই রঞ্জনের এত টেনশন।

'এয়ারপোর্ট নামেন, এয়ারপোর্ট এয়ারপোর্ট'।

হেলপারের চীৎকারে সন্বিৎ ফিরে পায় রঞ্জন। রাস্তায় কি আজ কোন জ্যাম ছিলনা নাকি, বাস থেকে নামতে নামতে ভাবে সে। একটু এগিয়ে উঠে পড়ে একটা খালি রিক্সায়। মোড়ের দোকানটা থেকে সকালের নাস্তার জন্য পাউরুটি কেনে রঞ্জন। কিছুক্ষণ ভেবেচিন্তে সিগারেটের প্যাকেটটার কথা মনে করতে পারলেও কলা কিনতে ভুলে যায়। অবশ্য সেটা সে নিজেও টের পায় না।

বাসায় এসে প্রথমে ল্যাপটপ অন করে ফ্রেস হয়ে নেয়। ফেসবুকে লগইন করে মিথিলাকে পাওয়া যায় না। একটু খটকা লাগলেও সময়টাকে কাজে লাগিয়ে রাতের খাবারটা খেয়ে নেয় সে। ফিরে আসার পরও মিথিলার কোন দেখা নেই। এবার কিছুটা দুশ্চিন্তা হয় রঞ্জনের। পরে ভাবে হয়ত ব্যস্ত আছে কোন কাজে, একটু পরে ঠিক চলে আসবে। বিছানার পাশের দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসে রঞ্জন হাতে তুলে নেয় কাফকা সমগ্র। 'রূপান্তর' নামের একটি গল্প কিছুটা পড়া হয়েছিল, সেটাই পড়তে থাকে। কিছুক্ষণ পরে ক্লান্ত লাগে, আর পড়তে ইচ্ছা করে না। ফেসবুকের এখানে ওখানে উদ্দেশ্যহীন ঘুরে বেড়াতে থাকে রঞ্জন। প্রতীক্ষা শুধু একটি সবুজ বাতি জ্বলে ওঠার। কি মনে করে মিথিলার পুরনো ম্যাসেজগুলা আবার পড়ে, কিছুটা সময় কাটে। এরপরও মিথিলাকে অনলাইনে দেখা যায় না। অফলাইনে আছে ভেবে দুই-একটা মেসেজ সেন্ড করে রঞ্জন। কিন্তু তবুও কোন সাড়া নেই। রঞ্জন এবার অধৈর্য্য হয়ে উঠতে থাকে, মনের আকাশে জমতে থাকে অভিমানের মেঘ। অনলাইনের বন্ধুত্বকে হঠাৎ খুব ঠুনকো বলে মনে হয়। রাত দুইটা বেজে গেছে। এইসময় সাধারণত ওরা কথা শেষ করে। কিন্তু এখনও দেখা নেই মিথিলার। দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়ে রঞ্জন। মিথিলার উপর খুব রাগ হয় আর নিজেকে কেমন যেন বোকা বোকা লাগে ওর। কষ্টে-দুঃখে ফেসবুক থেকে লগ-আউট করে ফেলে সে। মন খারাপ করে বসে থাকে কিছুক্ষণ, যথারীতি পুড়তে থাকে নিজের ভেতরে। কি মনে করে একটা নিউজ সাইটে ঢোকে। প্রথম নিউজটা দেখে চমকে ওঠে― ধানমন্ডিতে সড়ক দূর্ঘটনায় ভার্সিটি ছাত্রী নিহত। সন্মোহিতের মত নিউজটিতে ক্লিক করে রঞ্জন। ছাত্রীটির নাম মিথিলা। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে রঞ্জনের, গলার ভেতর কিছু একটা বেঁধে আছে বলে মনে হয়, হাত কাঁপতে থাকে। ধানমন্ডিতেই ভার্সিটি ছিল মিথিলার, বলেছিল ওকে। হঠাৎ একটা গাড়ির ব্রেক কষার শব্দ শুনতে পায় রঞ্জন। দরজার বাইরে, অথবা হয়ত নিজের মাথার ভেতরে। এসময় ঘরের আলোটা অনেক কমে আসে, ঘরটা যেন সংকুচিত হয়ে ছোট হয়ে যায়। সমস্ত পৃথিবীটা বৃত্তাকারে পাক খাওয়া শুরু করে। মাথা চেপে ধরে উঠে দাঁড়ায় রঞ্জন, ঘরের বন্ধ দরজাটার দিকে চোখ যায় তার। দরজার নীচ থেকে একটা সরু রক্তের ধারা প্রবেশ করে ঘরের ভেতর। বাড়তে থাকে আস্তে আস্তে, অধিকার করে নেয় মেঝের প্রতিটি ইঞ্চি। দেখতে দেখতে সাদা টাইলসের মেঝে মাখামাখি হয়ে যায় লাল টকটকে পিচ্ছিল রক্তে। রঞ্জন আর কিছু ভাবতে পারে না, শুধু সেই রক্তমাখা মেঝেতে দাঁড়িয়ে মাতালের মত টলতে থাকে। তার মনে হয় সে যেন আইডি কার্ড আনতে অফিসের ভেতর চলেছে আর প্রতি পদক্ষেপে রেখে যাচ্ছে একটি রক্তমাখা পায়ের ছাপ।

একটা আর্তচিৎকার দিয়ে উঠে বসে রঞ্জন। ঘেমে নেয়ে গেছে সে। মাথাটা ভার হয়ে আছে। ভীত দৃষ্টিতে একবার মেঝের দিকে তাকায়। লাইটটা জ্বলছে। ভোরের পাখি ডাকছে বাইরে। কয়টা বাজে এখন? মোবাইলটা হাতে নেয় সে। সাড়ে পাঁচটা। বেকায়দাভাবে শুয়ে ঘাড়ে প্রচন্ড ব্যাথা। বিছানার এক কোণায় খোলা অবস্থায় পড়ে আছে কাফকা সমগ্র। একটা লাইনের উপর চোখ পড়ে যায় রঞ্জনের― 'এক সকালে গ্রেগর সামসা অস্বস্তিকর সব স্বপ্ন থেকে জেগে উঠে দেখে সে তার বিছানায় পড়ে আছে এক দৈত্যাকার পোকায় রূপান্তরিত হয়ে'। বইটা বন্ধ করে রাখে রঞ্জন। তারপর দরজা খুলে বাইরে বের হয়। মলাটের উপর থেকে তার দিকে রহস্যময় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন ফ্রানৎস কাফকা।।


অরিন্দম গুস্তাভো বিশ্বাস
০২ সেপ্টেম্বর ২০১৩
ঢাকা

ঋণস্বীকারঃ
১. 'রূপান্তর' গল্পের লাইনটি নেওয়া হয়েছে পাঠক সমাবেশ থেকে প্রকাশিত 'ফ্রানৎস কাফকা গল্পসমগ্র' থেকে।
২. ছবিঃ The Persistence of Memory, ১৯৩১, সালভাদর দালি।