পৃষ্ঠাসমূহ

১ এপ্রি, ২০১৩

স্বপ্নবাজ মানুষেরা


এই পৃথিবীটা স্বপ্ন দেখা মানুষের জন্য খুব কঠিন জায়গা। সারাটা জীবন এই স্বপ্ন দেখার অপরাধের কারণে এদের শাস্তি পেয়ে যেতে হয়। অনেক সময় খুন হয়ে যেতে হয়। প্রাচীন গ্রীসে হাইপ্যাশিয়া নামের একজন মহিলা দার্শনিক ছিলেন, অনেক সূত্রমতে তাঁকে পাথর ছুঁড়ে হত্যা করা হয়েছিল। জীবনকালে গ্যালিলিও, কোপারনিকাস এদেরও অনেক নিগ্রহের শিকার হতে হয়েছে, এখন অবশ্য আমরা রাস্তার মোড়ে ভাষ্কর্য বানিয়ে তাঁদের অবদানের জন্য তাঁদের সন্মান করি। মাত্র কয়েকশো বছর আগেই ইটালিতে একজন ছিলেন, মৃত্যুদন্ডের আগে বলেছিলেন, Perchance you who pronounce my sentence are in greater fear than I who receive it, নাম তাঁর জর্দানো ব্রুনো। এই সূত্রে আরেকজনের কথা মনে পড়ল, তাঁর নাম অগাস্ট স্পাইস, আমরা যে মে ডে পালন করি সেই ইস্যুতেই শাস্তিপ্রাপ্ত ছিলেন তিনি। মৃত্যুর পূর্বে বলেছিলেন, The day will come when our silence will be more powerful than the voices you strangle today. এক মানবতাবাদী ছিলেন, যিনি মানুষের সমতাকে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন সারা পৃথিবীতে। নিজের উজ্জল ভবিষ্যত ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে এসে জীবন দিয়েছিলেন সাম্রাজ্যবাদীদের গুলিতে। তিনি কমোন্দান্তে চে গুয়েভারা।


আমাদের দেশেও এক স্বপ্নবাজ রাজনীতিবিদ ছিলেন। পাকিস্তানীদের আর পাকিস্তানপন্থীদের হাত থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করে আনতে পারলেও স্বাধীন দেশে অপমানের চূড়ান্ত হয়ে প্রায় বিশ্বাসঘাতক পদ পেয়ে বসেছিলেন। একটি নিরাপদ প্রকোষ্ঠে ব্রাশফায়ারে ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছিল তাঁর স্বপ্ন আর আক্ষেপভরা বুকখানি। ছিলেন একজন হুমায়ুন আজাদ, হাসিখুশী এই মানুষটির অস্ত্র ছিল তাঁর কলম। তাঁকে হত্যাচেষ্টার পর জার্মানির এক দরজাবন্ধ ঘরে কি হয়েছিল আমরা জানি না, আমরা ফিরে পেয়েছিলাম সেই মানুষটির মৃতদেহ।

বলিউডের 'রঙ দে বাসন্তী' সিনেমাটা অনেকেই দেখেছেন। আমার কাছে সিনেমাটির সবচেয়ে গুরুপ্তপূর্ণ অংশ হল প্রথমে বলা দু'টি লাইনঃ I always believed there were two kinds of men in this world, men who go to their deaths screaming, and men who go to their deaths in silence. Then I met a third kind.

এই মানুষগুলো বড় অদ্ভুত। মৃত্যু নিশ্চিত জেনে এরা এমন হয় কিভাবে? আমি মাঝে মাঝে ভাবি, এই মানুষগুলোর এইগুলা করে কি লাভ ছিল? নিজেরা নিজের ভোগ-বিলাসী জীবন নিয়ে থাকলেই পারতেন। বেঁচে থাকতেন বহুদিন, স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করতেন। কিন্তু আমি জানি, এমন মানুষগুলো ছিল বলেই মানবজাতি আজ গুহা থেকে হাইরাইজে উঠে এসেছে। গুহার দেওয়ালে পাথর ঘষে সাহিত্যচর্চা করা কোন স্বপ্নবাজ অস্ট্রালোপিথেকাস ছিল বলেই আজকের আধুনিক মানুষ ফেসবুকের স্ট্যাটাস বক্সে কি-বোর্ড চাপতে পারে। এটার নাম সভ্যতা, সভ্যতার এগিয়ে চলা।

প্রতিটি সময়েই একদল মানুষ থাকে যাদের এই এগিয়ে চলাটা সহ্য হয় না। তারা বেঁচে থাকে এই সভ্যতার উন্নয়নকে পেছনে টেনে ধরার জন্য। বর্তমান সময়ও তার ব্যাতিক্রম নয়। তবে আশার কথা আমার চারিপাশে এখনও কিছু সাচ্চা মানুষ দেখি। যাদের সাহস আছে, জীবনদর্শন আছে, প্রচন্ড অসৎ প্রতিরোধেও যারা অটল থাকে। জল্লাদের চকচকে খড়গ গলায় নেমে আসার আগের মূহুর্তে ব্রেভহার্টের উইলিয়াম ওয়ালেসের মত যারা চীৎকার করে বলতে পারবেঃ ফ্রী - ড - ম!


অরিন্দম গুস্তাভো বিশ্বাস
০১ এপ্রিল ২০১৩
খুলনা