কেরামত মিয়াকে পেশায়
একজন ব্যবসায়ী বলা যায়। ঢাকা এয়ারপোর্টের সামান্য পরেই তার একটি চায়ের দোকান আছে।
উনার স্ত্রী’র নাম সালমা বেগম,
তিনি একজন গার্মেন্টস কর্মী। তার দুই মেয়ে, এক ছেলে। বড় মেয়েটিকে বিয়ে দিয়েছেন।
মেঝ মেয়েটি তার সাথেই থাকে, মায়ের মত গার্মেন্টসে কাজ করে। আর ছোট ছেলেটি পাঁচ
বছরের, তার নাম সোহেল। নিকুঞ্জ ২০ নম্বর রোডের শেষে একটি ছাঁপড়া ঘরে তাদের বাসা।
বাসা বলতে একটি বড় বস্তির মধ্যে ছোট্ট একটি ঘর।
কেরামত মিয়া অনেক
সকালে দোকানে চলে আসেন। সালমা বেগম কাজে যাওয়ার আগে সোহেলকে তার কাছে দিয়ে যান।
সারাদিন সে বাবার সাথে থাকে। কাজ শেষে বাড়ী যাবার সময় আবার সালমা বেগম তাকে নিয়ে
যান। কেরামত মিয়া বাসায় ফেরেন অনেক রাতে। তাই সোহেলের সাথে তার সময় কাটানো বলতে
কেবল দোকানে থাকা সময়টুকু। এই সময়ের মাঝেই সোহেল তার ছোট্ট মনের সব প্রশ্ন তার
বাবার কাছে করে যায়। কখনও বাবার দিকে তাকিয়ে, কখনও বা আপন মনে –
সোহেলঃ আব্বা, ও
আব্বা...
কেরামত মিয়াঃ হু...
সোহেলঃ ঐডা কি?
কেরামত মিয়াঃ ঐডা
পেলেন।
সোহেলঃ উইরা কই যায়?
কেরামত মিয়াঃ বিদ্যেশ
যায়।
সোহেলঃ ও... আইচ্ছা
আব্বা, আকাশের উপরে কি বিদ্যেশ?
কেরামত মিয়াঃ না।
সোহেলঃ তুমি যে কইলা
পেলেন বিদ্যেশে যায় আকাশের উপরে উইরা...
কেরামত মিয়া এর কোন
উত্তর খুঁজে পান না, তাই চুপ করে থাকেন।
সোহেলঃ আব্বা, আকাশের
উপরে কি আছে?
কেরামত মিয়াঃ আকাশের
উপরে বেহেশত্ আছে, আল্লাহ্ থাকে।
সোহেলঃ আব্বা,
আল্লাহ্ কি গামছা পরে?
সোহেলের এই প্রশ্নে
কেরামত মিয়ার দোকানের সব খদ্দেররা হাসতে আরম্ভ করে। তিনি নিজে প্রথমে কিছুটা অপ্রস্তুত
হলেও পরে নিজেও হাসিতে যোগ দেন।
সবাইকে হাসতে দেখে
সোহেলও হাসতে থাকে।
সোহেলঃ বিদ্যেশ কারা
যায় আব্বা?
কেরামত মিয়াঃ
বড়লোকেরা যায়।
সোহেলঃ তুমি গেছ
আব্বা?
কেরামত মিয়াঃ নাহ্।
সোহেলঃ যাওনাই ক্যান
আব্বা? তুমি বড়লোক না?
কেরামত মিয়াঃ না।
সোহেলঃ বড়লোক ক্যামনে
হয় আব্বা? তাইলে কি নানা বিদ্যেশ গ্যাছে, হের তো দারি সাদা হইছে...
কেরামত মিয়ার কাছে
কোন উত্তর থাকে না এবারও।
সোহেলঃ ঐ গাছের পিছনে
কি আছে আব্বা?
কেরামত মিয়াঃ ওর
পিছনে মিরপুর।
সোহেলঃ ঐখানে কি বাঘ
আছে?
কেরামত মিয়াঃ আরে
নারে বেটা, বাঘ নাই।
সোহেলঃ নাই ক্যান
আব্বা? তুমি যে সেদিন কইলা বনে বাঘ থাকে...
কেরামত মিয়াঃ সব বনে
থাকে না। সুন্দরবন এ থাকে।
সোহেলঃ এই বনডা
সুন্দর না আব্বা?
কেরামত মিয়াঃ জানিনা।
অহন এট্টু চুপ কর।
কিন্তু সোহেল অত সহজে
চুপ করার পাত্র নয়।
সোহেলঃ আব্বা, আজকে
এত লোক ক্যান?
কেরামত মিয়াঃ
প্রধানমন্ত্রী আইছে তাই।
সোহেলঃ হেয় কেডা?
কেরামত মিয়াঃ এই
দেশের রাজা।
সোহেলঃ হের কি অনেক
বড় চায়ের দোকান আছে?
কেরামত মিয়াঃ সোহেল,
বাবা একটু চুপ কর তো তুই।
সোহেলঃ আব্বা তুমি
খারাপ!
কেরামত মিয়াঃ হু...
সোহেলঃ আব্বা, খিদা
লাগিছে।
কেরামত মিয়াঃ এই নে,
রুটি খা।
সোহেলঃ খিদা লাগে
ক্যান আব্বা?
কেরামত মিয়াঃ রুটি
খা, পরে বলুম। খাওয়ার সময় কথা কইতে নাই।
সোহেলঃ ও আইচ্ছা।
‘ও আলীর বাপ’ – ডাক শুনে চমকে ওঠেন সোহেল মিয়া। তার স্ত্রী শরীফা এসেছে ছেলে
আলীকে দোকানে দিয়ে যেতে, তাকে কাজে যেতে হবে। ছেলেটা তার প্রচুর কথা বলে। সোহেল
মিয়া মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলেন, ছেলেকে আর কখনও চুপ করতে বলবেন না।
আলীঃ আব্বা, ও
আব্বা...
সোহেল মিয়াঃ হু...
আলীঃ ঐডা কি?
সোহেল মিয়াঃ ঐডা
পেলেন।
...
...
বিমানের গর্জনে
মুখরিত ঢাকা এয়ারপোর্ট। একটি বিমান রানওয়ে দিয়ে ছুটে চলেছে আকাশ ছোঁবার
প্রত্যাশায়।।
[ বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ ‘আব্বা, আল্লাহ্ কি গামছা পরে?’ এর প্রশ্নটি অনেক আগে ‘শিশু’ পত্রিকার কোন একটি গল্পে পড়েছিলাম। সেই গল্পের শুধু এই একটি
লাইন-ই মনে আছে, সেটা এখানে ব্যবহার করলাম ]
উৎসর্গঃ সোহেল-কে। যে
ছেলেটি কাকলী-উত্তরা রুটের বাসে লজেন্স ফেরী করে। পকেটে টাকা না থাকলেও চোখভর্তি
স্বপ্ন আছে তার। আর আছে একটি নিষ্পাপ হাসি, যা আমার সাথে দেখা হলেই সে উপহার দেয়
নিঃসঙ্কোচে।
অরিন্দম গুস্তাভো
বিশ্বাস
০৩ অক্টোবর ২০১০
ঢাকা