মানুষের মূল পরিচয়টা আসলে
কোথায়? একজন মানুষের আসল পরিচয় লুকিয়ে থাকে তাঁর বেড়ে ওঠা সংস্কৃতির শেকড়ে। এরপর সে
যেখানেই যাক না কেন এই শেকড় সে আর তুলে ফেলতে পারে না। স্বাভাবিকভাবেই পৃথিবীর বিভিন্ন
সংস্কৃতির মধ্যে রয়েছে পার্থক্য―
আচরণে, আবেগ-অনুভূতির প্রকাশে। একইভাবে আমাদের
উপমহাদেশীয় এবং পশ্চিমা সংস্কৃতি তথা জীবনাচারণের মধ্যে রয়েছে বিস্তর ফারাক। এই দুই
সংস্কৃতির সংস্পর্শে বেড়ে ওঠা দুইটি প্রজন্মের মধ্যে যে সংঘাত সময়ের সাথে অনিবার্য
হয়ে ওঠে সেটাকে উপজীব্য করেই পরিচালক মীরা নায়ার নির্মাণ করেছেন তাঁর ২০০৬ সালের চলচ্চিত্র
দ্য নেমসেক। মীরা নায়ারের ক্যামেরা এই
সংঘাতের একটি সৎ পর্যবেক্ষন করার চেষ্টা করেছে মাত্র, কোন সম্ভাব্য সমাধানে পৌঁছানোর
চেষ্টা এই সিনেমার মাধ্যমে করা হয়নি। সিনেমাটি নির্মিত হয়েছে ঝুম্পা লাহিড়ীর একই নামের
উপন্যাস অবলম্বনে।
সময়কাল সত্তর দশকের শেষভাগ।
পরিবারিকভাবে ঠিক করে অসীমার বিয়ে হয় নিউইয়র্ক প্রবাসী অশোক গাঙ্গুলীর সাথে। নতুন বৌকে
নিয়ে অশোক ফিরে যায় আমেরিকায়। অসীমা মানিয়ে নিতে থাকে নতুন পরিবেশে। সময় কেটে যেতে
থাকে। কয়েক বছরের মধ্যে জন্ম হয় ছেলে গোগোল এবং মেয়ে সোনিয়ার। অশোক ছেলের নাম গোগোল
রাখে বিখ্যাত রাশান সাহিত্যিক নিকোলাই গোগোলের নামানুসারে। এই নাম রাখার পেছনে প্রধান
কারণ হিসেবে কাজ করে বহুবছর আগে তাঁর জীবনে ঘটে যাওয়া একটি গুরুপ্তপূর্ণ ঘটনা। বড় হয়ে
ওঠার সাথে সাথে গোগোল তাঁর নিজের নামকে নিয়ে আর স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতে পারে না। এছাড়া
বিভিন্ন বিষয়ে পশ্চিমা সংস্কৃতিতে বেড়ে ওঠা গোগোলের মতের মিল হতে চায়না তাঁর বাঙালি
বাবা-মা'র সাথে। স্বাভাবিকভাবেই বাবা-মা'র সাথে বাড়তে থাকে দূরত্ব। বাবা তাকে বলেন,
'We all came out of Gogol's Overcoat, one day you will understand'. কিন্তু বাবার
এইসব কথা গোগোলের অর্থহীন আর বিরক্তিকর বলে মনে হয়। হঠাৎ একটি পারিবারিক দুর্ঘটনায়
ওলটপালট হয়ে যায় সবকিছু। অপরাধবোধে ভুগে গোগোল এবার বাঙালি হতে চায়। কিন্তু পশ্চিমা
সংস্কৃতিতে যার শেকড়, সে কি চাইলেই বাঙালি হতে পারবে?
সিনেমার শুরুতেই টাইটেল মিউজিকের
সময় ক্রেডিটের সাথে আমরা বিভিন্ন রঙের ব্যাকগ্রাউন্ড দেখতে পাই। সেটা দেখে কেন যেন
মনে হয় সকল চরিত্রের ব্যাকগ্রাউন্ড বা শেকড় আলাদা আলাদা, কিন্তু প্রত্যেকটিই রঙীন।
এই রূপক দিয়ে যে সংস্কৃতিকে বুঝানো হচ্ছে সেটা আমরা বুঝতে পারি সিনেমার সাথে সাথে।
আবার টাইটেল মিউজিকটি ঠিক উপমহাদেশীয়ও নয়, পশ্চিমাও নয়― যেন এই দু'য়ের এক পরিমিত মিশ্রণ। বলা হয়, টাইটেল মিউজিকের কাজ হচ্ছে দর্শককে
সিনেমাটি দেখার জন্য প্রস্তুত করা। তাই এক্ষেত্রে এটাকে সার্থক বলা যায় নিঃসন্দেহে।
সিনেমাটির গল্প বলার স্টাইল
সরলরৈখিক। হয়ত এ কারণেই সিনেমাটি আরও সহজবোধ্য হয়েছে এবং দর্শকদের সাহায্য করেছে গল্পটির
মূল বিষয়বস্তুর জায়গাটাতে বেশী মনোযোগ দেওয়ার জন্য। এছাড়াও গল্পের পটভূমি পরিবর্তনের
সাথে সাথে দর্শনের যে পরিবর্তন, সেটাকে চিত্রায়ন করা হয়েছে অসাধারণ দক্ষতায়। অশোক-অসীমা
বা কলকাতার ক্ষেত্রে ক্যামেরা প্রচন্ডরকম বাঙালি, আবার গোগোলের পশ্চিমা জীবনাচারণের
সাথে ক্যামেরাও পশ্চিমা হয়ে ওঠে।
শুরুতে আমরা পূজার বাজনার
সাথে বীণা হাতে সরস্বতীর মূর্তি দেখতে পাই। জ্ঞান, সঙ্গীত ও শিল্পকলার দেবী হলেন সরস্বতী।
এর পরের শটেই আমরা দেখতে পাই রাগসঙ্গীত অনুশীলনরতা অসীমাকে। সঙ্গীতের সাথে অসীমার সম্পর্ক
বুঝাতে সহজ একটি মন্তাজ শট এবং এর কিছুক্ষণ পরেই অসীমার বাবার কাছে আমরা জানতে পারি
যে অসীমা ছোটবেলা থেকেই ক্লাসিক্যাল মিউজিক শিখছে।
কলকাতা শহরের স্ট্যাবলিশমেন্ট
শটের জন্য বেশীরভাগ পরিচালকের প্রথম পছন্দ হাওড়া ব্রীজ, মীরা নায়ারও তার ব্যাতিক্রম
নন। এছাড়া কলকাতার রাস্তায় গাড়ী-ট্রামের যানজট, রাজনৈতিক মিছিল, কলকাতার রাস্তা, সেখানে
ঘুমন্ত মানুষ, ধুলো-ময়লা, শীতের ভোরে কুয়াশায় ঢাকা হাওড়া ব্রীজ আর ঘাটে স্নানরত মানুষ,
পুরনো দালান-কোঠা এগুলো দারুণভাবে বাঙালি শট। রাগসঙ্গীতের পরপরই এই শটগুলো দর্শকদের
মুহূর্তে বাঙালি সংস্কৃতির কাছাকাছি নিয়ে আসে। এছাড়া অশোক-অসীমার চরিত্রের সাথে মিলিয়ে
হাওড়া ব্রীজ দেখানোতে আমরা বুঝি যে এরা দু'জন আসলে একই শহরের বাসিন্দা। এডিটিং এর একটা
কথা না বললেই নয়। কয়েকটি শট কুইককাটে জোড়া দিয়ে ট্রেন এক্সিডেন্টের দৃশ্যটা যেভাবে
ফুটিয়ে তোলা হয়েছে তা সত্যিই প্রশংসনীয়।
নিউইয়র্কে বহুবছর কাটিয়েও
অশোক-অসীমা বাঙালি থেকে যায়। অশোক তাঁর ছেলের সাথে বন্ধুর মত মিশতে চায়, পারিবারিক
অনুষ্ঠানে তাঁর উপস্থিতি কামনা করে, অসীমা দুইদিন ধরে রান্না-বান্না করে ছেলের বাড়ি
আসার পথ চেয়ে থাকে। কিন্তু গোগোলের কাছে এগুলো অর্থহীন। সে বড় হয়েছে ভিন্ন এক সংস্কৃতিতে।
ছেলে-মেয়েদের উদার মেলামেশা, বন্ধুদের সাথে পার্টি-মারুয়ানা, রক-হেভীমেটাল সঙ্গীত― এসবই তাঁর পছন্দ। তাই দেখা যায় জন্মদিনেও তাঁর খোঁজ থাকে না, গন্তব্যে পৌঁছে
সে মা'কে ফোন করতে ভুলে যায়, বাবার উপহার দেওয়া বইয়ের প্রতিও তাঁর কোন আগ্রহ নেই। এই
আচরণগুলো গোগোলের জন্য খুবই স্বাভাবিক। কলকাতায় বেড়াতে এসে প্রথম দিনেই সোনিয়া বলে,
'I wanna go home'. গোগোল ও সোনিয়া নিউইয়র্ককেই তাদের বাড়ি বলে মনে করে।
দুই প্রজন্মের একই ধরণের কিছু
ঘটনার মাধ্যমে এই সাংস্কৃতিক পার্থক্যটা আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। অসীমাকে দেখতে আসার দিন
অসীমা অশোকের বাবা-মা'কে পা ছুঁয়ে প্রণাম করে। অপরদিকে গোগোলের গার্লফ্রেন্ড ম্যাক্সিন
প্রথম দেখাতে অশোক এবং অসীমাকে নাম ধরে সম্বোধন করে এবং চুমু খায়। ম্যাক্সিনের কাছে
স্বাভাবিক হলেও এটা একটা অপ্রস্তুত পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। গোগোল যদিও ম্যাক্সিনকে
শিখিয়ে নিয়ে এসেছিল যে 'No kissing, no holding hands', কিন্তু খেতে বসে ম্যাক্সিন
অভ্যেসবশত গোগোলের হাত ধরে ফেলে। কিন্তু পেছনে ফিরে গেলে আমরা দেখি প্রথম দর্শনে অশোক
এবং অসীমা পরষ্পরের দিকে ঠিকমত তাকাতেই পারেনি। একইভাবে অশোক-অসীমাকে বিদায় জানাতে
এয়ারপোর্টে দুই পরিবারের বহু মানুষের সমাগম হলেও বাবাকে বিদায় জানাতে গোগোল আসতে চায়
না। গোগোল-মৌসুমীর প্রেমে পড়া, স্ত্রী হিসেবে মৌসুমী, মৌসুমীর শেষ নাম পরিবর্তন না
করা― এসবের কোনটিই অশোক-অসীমার মত নয়।
মাথা কামিয়ে ফেলা গোগোলের
হেঁটে আসাটা পরিচালক স্লো মোশনে দেখিয়েছেন। কিন্তু কেন? দুই সংস্কৃতির যুদ্ধ গোগোলের
ভেতরেও চলমান। ঐ দৃশ্যেই কেন যেন মনে হয় গোগোল পুরোপুরি আমেরিকান হতে পারেনি, আবার
বাঙালিও হতে পারেনি। ব্যাপারটা অনেকটা মার্ক্সের ডায়ালেক্টিক্যাল মেথডের মত। এই দু'য়ের
মধ্যবর্তী স্থানে দুলতে থাকা গোগোল তাই স্থির হতে পারেনা, হয়ত নতুন কিছু একটা হয়ে ওঠে।
তাই পরবর্তীতে দেখা যায় বাঙালি হওয়ার চেষ্টাতেও গোগোল ব্যর্থ হয়। মা'র প্ররোচনায় প্রেমে
পড়ে মৌসুমীকে বিয়ে করলেও শেষ পর্যন্ত সংঘাতটি ছিল অনিবার্য। অসীমার চিন্তা ছিল যে মৌসুমী
বাঙালি। কিন্তু বাঙালি হলেও মৌসুমী বেড়ে উঠেছে পশ্চিমা সংস্কৃতিতে। তাই সাধারণ বাঙালি
স্ত্রী হওয়া তাঁর পক্ষে অসম্ভব। তাই মৌসুমীকে বলতে দেখি― 'I saw myself becoming my mother. I saw myself stuck'.
সিনেমাটি দেখার পর সবার মনে
একটি চিন্তাই আসবে যে, 'We all came out of Gogol's Overcoat' এই কথাটির অর্থ কি? আধুনিক
রাশান সাহিত্যে নিকোলাই গোগোলের প্রভাব বুঝাতে এই কথাটা বলেছিলেন ফিওদর দস্তয়ভস্কি।
সিনেমাটির ক্ষেত্রে বিভিন্নভাবে কথাটা ব্যাখ্যা করা সম্ভব। অশোকের ধারণা ছিল যে ঐ বইটির
জন্যই সেই দূর্ঘটনা থেকে সে নতুন জীবন ফিরে পেয়েছিল। তাই সে গোগোলকে বলে― 'You remind me of everything that followed. Every day since then has
been a gift, Gogol'. আবার আমরা দেখি যে এমন একটি পরিস্থিতিতে অশোক 'গোগোল'
নামটি রেখেছিল যে অন্য কোন নাম রাখা হয়ত তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি। ওভারকোট গল্পটিতে মূল
চরিত্রের নাম আকাকি আকাকিভিচ রাখার পক্ষে যুক্তি দিয়ে নিকোলাই গোগোল যেমন লিখেছেন― 'The circumstances were such that it would have been impossible to
give him any other name'.
সিনেমার শেষে দেখা যায় ট্রেনে
বসে দ্য ওভারকোট গল্পটি পড়ছে গোগোল, ঠিক তাঁর বাবার মতই। এই দৃশ্য দেখে বিখ্যাত পরিচালক
ঋত্বিক ঘটকের কথা মনে হয়, যিনি তাঁর সিনেমায় সর্বদা একটি বৃত্তাকার আবহ সৃষ্টি করতেন।
ট্রেনে বসে গোগোল তাঁর বাবার কন্ঠস্বর শুনতে পায়― 'Pack a
pillow and blanket. Go, see the world. You will never regret it Gogol'. তাই হয়ত
গোগোল বেরিয়ে পড়ে আত্মপরিচয়ের সন্ধানে।
শিল্পীরা সবাই ভাল অভিনয় করলেও
নজর কেড়েছে টাবু এবং কাল পেন এর অভিনয়। অশোক চরিত্রে ইরফান খান ছিলেন অনবদ্য।
দ্য নেমসেক আমাদের জীবনের
খুব কাছের একটি গল্প। পূর্ব-পশ্চিমের সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্ব নিয়ে নির্মিত সিনেমাগুলোর
মধ্যে আমার দেখা এটাই এখন পর্যন্ত শ্রেষ্ঠতম। দুই সংস্কৃতির সংঘাতে যে আপাত পরিচয়হীনতা,
এর শেষ কোথায় তা আমাদের জানা নেই।।
অরিন্দম গুস্তাভো বিশ্বাস
০১ আগষ্ট ২০১৩
ঢাকা