মোমের আলোয় আজ গ্রন্থের কাছে
ব'সে―অথবা
ভোরের বেলা নদীর ভিতরে
আমরা যতটা দূর চ'লে যাই―চেয়ে দেখি আরো-কিছু আছে তারপরে।
― জীবনানন্দ
দাশ
১.
সে বহুকাল আগের কথা। গৌড়বঙ্গের
রাজধানী লক্ষ্মণাবতীতে মহামহীম পরম ভট্টারক শ্রী লক্ষ্মণ সেন দেব সিংহাসনে অধিষ্ঠিত।
তবে তাঁর মহাসামন্ত ও সামন্তবর্গ প্রজাপালনের কোনো কাজ করে না। তারা বরঞ্চ বিলাসব্যসন
ও প্রজাপীড়নেই অধিক মত্ত। এই যেমন অতিসম্প্রতি পিপ্পলী হাটের সামান্য ঘটনাকে কেন্দ্র
করে সৃষ্ট গোলযোগে সামন্ত হরিসেনের প্রচন্ড নিষ্ঠুরতার কথা সবার মুখে মুখে ফিরছে। বরেন্দ্রভূমিতে
তখন নির্বিচারে প্রাণ বধ হচ্ছে, গৃহ লুন্ঠিত হচ্ছে, পল্লী প্রজ্বলিত হচ্ছে। পুনর্ভবা,
আত্রেয়ী, করতোয়ার উভয় তীরের বিস্তীর্ণ ভূ-ভাগের জনপদগুলির তখন প্রায় এরূপই অবস্থা।
এমনি সময়ে কুম্ভকার রুহিদাসের পুত্রটিকে নিয়ে ঘটে যাওয়া ঘটনাকে কেন্দ্র করে এক রাত্রিতে
পুড়ে ছাই হয়ে গেল পুনর্ভবা নদীতীরের উজুবট গ্রাম।
এ গ্রামেই নিবাস ছিল লীলাবতীর।
তার সঙ্গী ছিল আত্রেয়ী তীর নিবাসী মৃৎশিল্পী শ্যামাঙ্গ। নিয়তির অঙ্গুলি হেলনে তাদের
জীবনের পথ কখন যে একত্রে মিলে গিয়েছিল, সেটা তাদের নিজেদেরও অজ্ঞাত। উজুবটের সেই প্রজ্বলিত
অগ্নিশিখা থেকে পলায়নের ক্ষণেই হয়ত।
ওদিকে যবন জাতির আক্রমণ অত্যাসন্ন।
কেউ কেউ তাদের দেখেছে, অনেকেই দেখেনি। তবে এদের সম্পর্কে অনেক কথা প্রচলিত আছে। এরা
অশ্বারোহনে অত্যন্ত দ্রুতগতি― আর অস্ত্রচালনায় যন্ত্রবৎ। হিংস্রতায় একেকজন যমের অনুচর।
তারা শুধু রাজ্য জয়ই করছে না― ধর্মকে পর্যন্ত জয় করে নিচ্ছে।
শুনতে পাওয়া যায়, পশ্চিম দেশাগত
যবনদের আক্রমণে মহারাজ লক্ষ্মণ সেন নওদীয়ার প্রাসাদ থেকে পলায়ন করেছেন। নওদীয়ার প্রাসাদ
ধ্বংস হতে বিলম্ব হয়নি। লক্ষ্মণাবতীও হয়েছে যথেচ্ছ লুন্ঠিত। সেনাপতিরা পলায়ন করেছেন।
যবনেরা এখন সদলবলে নগরের পর নগর লুন্ঠন করে চলেছে। যে কোনদিন পুন্ড্রনগরীতেও তারা এসে
যেতে পারে।
তবু পুন্ড্রনগরী পানেই চলছিল
শ্যামাঙ্গ ও লীলাবতী। সে অনেক দীর্ঘ পথ। প্রথমে পদব্রজে, অতঃপর গো-শকটে। যদিও চলমান
ঘটনায় তাদের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন আনীত হয় না। তখন ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয়রা নির্যাতন করতো,
এখন যবনেরা করবে― একই
ব্যাপার।
এই কি মানুষের জীবন? সুখ নেই,
স্বস্তি নেই, গৃহ নেই, কেবলি প্রাণ নিয়ে পলায়ন করতে হচ্ছে― এর শেষ কোথায়? এ জীবন কি যাপন করা
যায়? কতদিন এভাবে চলবে?
এর অব্যবহিত পরেই অধিকৃত হয়ে
যায় পুন্ড্রনগরী। মহাকালের নিয়ম মেনেই পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হয় শ্যামাঙ্গকে, লীলাবতী
হারিয়ে যায় ধূসর প্রদোষকালের গহ্বরে।
২.
'কোন মালাউনের বাচ্চা এই পবিত্র
পাকিস্তানে থাকবে না'― কথাটা বলেই দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল গোলাম আলী।
নদীর ধারে স্কুলঘর। নদীর নাম
মাথাভাঙা। নদী বললেও এটা আসলে একটি শাখানদী। পদ্মার একটা শক্তিশালী শাখা দিক পরিবর্তন
করে ভেতরে ঢুকে এসেছে। একসময় ভীষণ গতিময় ছিল। বর্ষাকালে ফুলে-ফেঁপে উঠে সংহারী মূর্তি
ধারণ করত তখন। তবে এখন আর সেই জৌলুস নেই। বহুযুগ আগে এই নদীকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছিল
লোকালয়। জীবিকার খোঁজে এসে এখানেই বসতি স্থাপন করেছিল অনেক মানুষ। সুবল মাস্টারের পূর্বপুরুষেরা
ছিলেন তাদেরই দলে।
স্কুলঘরটা বেশ পুরোনো। সুবল
মাস্টারের বাবা ছিলেন এই স্কুলের শিক্ষক। ছোট্ট সুবল তাঁর বাবার হাত ধরে স্কুলে আসত
প্রতিদিন, একইভাবে বাড়ি ফিরত ছুটির পর। সহপাঠীরা সবাই ছিল তার প্রাণের বন্ধু, তাদের
সাথে এই স্কুলমাঠে কত ছুটোছুটি আর খেলাধূলা করে কেটেছে বিকেলগুলো। সুবল মাস্টারের বাবা
ছিলেন সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তি, সকলেই তাকে সন্মান করত। তিনিও গত হয়েছেন প্রায় বছর
দশেক আগে। ভালই হয়েছে― মনে মনে ভাবেন সুবল মাস্টার, দেশের এই অবস্থা তাকে দেখতে
হয়নি। ক্লান্ত ভঙ্গীতে স্কুলঘরের চেয়ারটাতে বসে থাকেন তিনি। কি করবেন ভেবে কূল-কিনারা
করতে পারেন না।
দেশভাগের প্রায় আড়াই বছর পার
হয়ে গেলেও পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি মোটেও, বিদ্বেষ থেকে গেছে অনেকটা ছাইচাপা আগুনের
মত। অনেকেই চলে গেছে ওপারে। ছোটবেলার খেলার সঙ্গী সুভাষ, ওপাড়ার নিমাই বাবু, ধনঞ্জয়
মন্ডল তাদের পরিবার সহ চলে গেছেন দেশভাগের সময়টাতেই। সুবল মাস্টারের বড় কাকা চলে গেছেন
তাও প্রায় বছর ঘুরতে চলল। সুবল মাস্টারকে তিনি অনেক বুঝিয়েছিলেন, ওপারে পালিয়ে গিয়ে
প্রাণ বাঁচাবার কথা। সুবল মাস্টার যেতে পারেননি। নিজের মেয়েটির মুখের দিকে তাকিয়ে সিদ্ধান্তহীনতায়
ভুগেছেন বটে, কিন্তু পূর্বপুরুষের ভিটেমাটি ছেড়ে যেতে তাঁর মন সায় দেয়নি। তিনি কি তবে
ভুলই করে ফেললেন? নিজের উপর তাঁর সন্দেহ হতে থাকে। সুবল মাস্টার ধীরে ধীরে হাঁটতে থাকেন
বাড়ির দিকে।
সুবল মাস্টারের গিন্নী কপিলা
দেবী। স্বামীকে দেখেই ছুটে এসে জানান ঢাকায় চলমান গন্ডগোলের কথা, পাশের বাড়ি থেকে শুনে
এসেছেন তিনি। ব্যাপারটা সুবল মাস্টারের কানেও এসেছে, স্ত্রীকে জানাতে চাননি। ঢাকা ফেরত
একজনের কাছে জানতে পেরেছেন যে সারা শহরজুড়ে নাকি হত্যা, লুণ্ঠন আর অগ্নিসংযোগ চলছে,
নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে বহু পরিবার। ট্রেনে-স্টীমারে চলছে সহিংসতা, এমনকি চলন্ত ট্রেন থেকে
যুবতী মেয়েদের উঠিয়ে নিয়ে যাবার ঘটনাও ঘটছে। পাশের গ্রামের এক মালো পরিবার নাকি এমনিভাবে
রাতের অন্ধকারে তাদের মেয়েকে হারিয়ে ফিরে এসেছে। কপিলা দেবী স্বামীর কাছ থেকে কোন সিদ্ধান্ত
শুনতে চান, চোখে আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে থাকেন। সুবল মাস্টার কিছু বলেন না, সাবধানে বুকে
চেপে রাখা একটা দীর্ঘশ্বাস বের করে দেন। গোলাম আলীর ক্রূর হাসিটা তাঁর চোখে বারবার
ভেসে উঠতে থাকে।
৩.
উজ্জ্বল শরৎকাল। চারিদিকে
সোনালী রোদ ছড়িয়ে আছে। আকাশে পুঞ্জ পুঞ্জ সাদা মেঘ ভেসে চলেছে অবিরাম। মেঘেরা যেন চলেছে
কোন উৎসবে। টাংগন নদীর পাড়ে ঘন কাশফুল বাতাসে দোল খায়। কাশবনের সীমানা শেষে শুরু হয়েছে
বিস্তৃত ধানক্ষেত। সালাম আর বাসন্তী বসে ছিল সেই ধানক্ষেতের প্রান্তে।
এই গ্রামেই ওদের দু'জনের বাড়ি।
তরুণ বয়সের মন দেওয়া নেওয়া চলছে তাদের। সর্বদা উচ্ছল বাসন্তীকে কেন যেন আজ কিছুটা বিমর্ষ
বলে মনে হয় সালামের। সে একটা কাশফুলের ডাঁটা চিবাতে থাকে গভীর মনোযোগ দিয়ে। দেশের অবস্থা
বেশী ভাল নয়। যুদ্ধ চলছে সবখানে। এ গ্রামে যদিও এখনও কিছু হয়নি কিন্তু অন্য গ্রামের
ভয়ংকর সব খবর প্রায়ই এসে পৌঁছায়। শোনা যায় পাকিস্তানী মিলিটারিরা জ্বালিয়ে দিয়েছে পুরো
গ্রাম, মেরে ফেলেছে নিরপরাধ মানুষদের। এ গ্রামের শেষ প্রান্তের স্কুলঘরটিতে দু'দিন
আগে মিলিটারিরা ক্যাম্প বানিয়েছে। তাই ইদানিং সবার মধ্যে একটা চাপা উৎকন্ঠা কাজ করে।
কখন কি হয়ে যায় কেউ বলতে পারে না।
এদিকে বাসন্তী ভাবছে ভিন্ন
কথা। পাশের পাড়ার বখতিয়ার আলী তার বাবাকে এসে শাসিয়ে গেছে গতরাতে। হুমকি দিয়ে বলেছে
ওপারে চলে না গেলে নাকি বিপদে পড়তে হবে। নোংরা কৌতুক করে এটাও বলেছে যে মিলিটারিরা
নাকি মালাউন যুবতী মেয়েদের পছন্দ করে। এর মানে বুঝতে বাসন্তীর কষ্ট হয় না। আজকে সকালে
সে বাবা-মা'কে আলোচনা করতে শুনেছে যে গ্রামে মিলিটারি চলে এসেছে, খুব তাড়াতাড়ি তাদের
এদেশ ছাড়তে হবে। এই খবরটা সে সালামকে জানাতে চায় কিন্তু ভালবাসার মানুষটির মন খারাপ
করে দিতে ইচ্ছা করে না তার। তাই চুপ করে থাকে সে। একটু পর উঠতে হয় ওদের। বাসন্তীকে
ঘরে ফিরতে হবে, সালামকেও যেতে হবে গঞ্জের দিকে। তবে সালাম কথা দেয় সন্ধ্যায় এসে দেখা
করবে।
গঞ্জ থেকে ফিরতে একটু দেরী
হয়ে যায় সালামের। কিন্তু ততক্ষণে আসলে অনেক দেরী হয়ে গেছে, আগুনে জ্বলছে পুরো গ্রাম।
সালাম পাগলপ্রায় হয়ে বাসন্তীদের বাড়ির দিকে ছোটে। বাড়িটা পুড়ে ছাই হয়ে গেছে, ইতস্তত
ছড়ানো মৃতদেহ। বাসন্তীর বাবার কুমোরের চাকাটার উপরে তখনও ভিজে কাদামাটি, পাশে ভাঙ্গা
পানির পাত্র। কিন্তু বাসন্তীকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। নিজের অজান্তেই একটা আর্তচীৎকার
বেরিয়ে আসে সালামের গলা থেকে। প্রচণ্ড আক্রোশে কি করবে ভেবে পায় না সে। হঠাৎ কি চিন্তা
করে দৌড়ে বেরিয়ে যায় বাইরে। কোথায় যায় কেউ জানে না।
সালামকে পাওয়া গিয়েছিল সপ্তাহখানেক
পর। টাংগন নদীর পাড়ে পড়ে থাকা অসংখ্য গলিত লাশের মধ্যে। যুদ্ধশেষে পাকিস্তানী ক্যাম্প
থেকে উদ্ধার করা হয়েছিল প্রচুর মেয়েদের। তাদের মধ্যে একজন জানিয়েছিল যে তাঁর নাম বাসন্তী।
তবে তাঁর চোখে কোন স্বপ্ন ছিল না, স্বভাবে ছিল না কোন উচ্ছলতা।
৪.
ছবির মত গ্রাম। পাশ দিয়ে বয়ে
গেছে আত্রাই নদী, মস্ত বড় সাপের মত এঁকেবেঁকে বরেন্দ্রভূমির ভেতর দিয়ে চলে গেছে চলনবিলের
দিকে। জানুয়ারী মাসের ঘন কুয়াশায় ঢেকে থাকলেও নদীর ধার ঘেঁষে ছড়িয়ে থাকা কাঁচা ঘরগুলো
চোখে পড়ে সহজেই। ওটার নাম মালোপাড়া, কারণ ঐখানে মালোরা থাকে। কেউ টিনের, কেউ বাঁশের
বেড়ার ঘর বানিয়ে কোনভাবে মাথাগোঁজার ঠাঁই করে নিয়েছে এখানে। এ পাড়াতে প্রায় গোটা পঞ্চাশেক
পরিবারের বসবাস। আগে আরও বেশী ছিল, নদীতে মাছ কমে যাওয়ায় অন্য পেশা বেছে নিতে বাধ্য
হয়েছে অনেক মালোরা।
মুখোমুখি যে ঘর দু'টি দেখা
যায় তার উত্তরমুখী ঘরটির দাওয়ায় বসে জাল সারাই করছিলেন রঞ্জন মালো। মোট সাতটি জাল আছে
তাঁর, প্রতিটির দাম প্রায় চার হাজার টাকা। এখানকার অন্যদের তুলনায় তাকে কিছুটা অবস্থাপন্নই
বলা চলে। তাঁর স্ত্রী দুলালী বুদ্ধিমতি মহিলা, সংসারটাকে দারুণভাবে আগলে রেখেছেন। বাড়ির
পাশের ছোট্ট জায়গাটিতে শীতের সবজি লাগিয়েছেন। পাশে দুইটি স্বাস্থ্যবান কলাগাছও নজরে
পড়ে, আধপাকা কলা ঝুলছে। মেয়েদের বিয়ের ব্যাপারেও আগেভাগে ভেবেছেন, তিল তিল করে টাকা
জমিয়ে কিনে রেখেছেন গহনা, শাড়ি ইত্যাদি। স্বামীর পাশেই একটা ছোট্ট টুলের উপরে বসে তিনি
পান তৈরি করছিলেন। অপরদিকের ঘরটির সামনে বসে ছিল মায়াবতী, তাঁর কোলে ছোট্ট শিশুপুত্র।
তাঁর স্বামী কিশোর রঞ্জন মালোর সাথে মাছ ধরে। কিন্তু তাঁকে ধারে-কাছে কোথাও দেখা যাচ্ছে
না বেশ কিছুক্ষণ। মায়াবতীর কিছুটা দুশ্চিন্তা হয়। অবশ্য দিনের এই সময়টাতে বাড়ির পুরুষেরা
সাধারণত বাড়িতে থাকে না। তবে আজকে কোন সাধারন দিন নয়।
দিনের আলো কিছুটা কমে এসেছে।
জালটা উঠোনের পাশে বাঁশটার উপরে ঝুলিয়ে রেখে এদিক-ওদিক পায়চারি করতে থাকেন রঞ্জন মালো।
দেশে আজ ভোট চলছে, এই নিয়ে চারিদিকে সরগরম। এই ভোট দেওয়া না দেওয়াকে কেন্দ্র করে সম্প্রতি
বেশ কিছু হুমকি-ধামকির ঘটনা ঘটেছে পাড়ায়। তবু পাড়ার কিছু যুবকেরা ভোট দেখতে যাওয়ায়
তাদের মারধর করে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বলে শুনেছেন। এটা নিয়েই তিনি কিছুটা উদ্বিগ্ন।
এখানে মালোরা বলতে গেলে নিরাপত্তাহীন, দেশের এই অবস্থায় কখন কি হয়ে যায় কিছুই ভরসা
নেই।
হঠাৎ পাড়ার দক্ষিণ দিক থেকে
চীৎকার-চেঁচামেচি শোনা যায়, ধোঁয়ার গন্ধ পাওয়া যায় প্রায় সাথে সাথেই। রঞ্জন মালো বাইরে
বের হতে উদ্যত হতেই কিশোর দৌড়ে এসে বাড়িতে ঢোকে। কিশোরের চোখে-মুখে ভয়ের চিহ্ন। রঞ্জন
মালোর আর কিছু বুঝতে বাকি থাকেনা। বাইরের হৈ-হল্লা বাড়তে থাকে। রঞ্জন মালোর চীৎকারে
মেয়েদের নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন তাঁর স্ত্রী, উঠোনের ওপাশের কোনায় সন্তান কোলে দাঁড়িয়ে
ভয়ার্ত মায়াবতী। সবাই অতিদ্রুত বাড়ির পেছনে নদীর ধারে গিয়ে দাঁড়ায়। লাঠি-সোঁটা নিয়ে
কিছু লোক বাড়ির ভেতরে ঢুকে ভাঙচুর করতে শুরু করে সবকিছু। নির্বাক দাঁড়িয়ে দেখা ছাড়া
তাদের আর করার কিছুই থাকেনা। নদীপাড়ে তাদের দেখে লাঠি হাতে ছুটে আসে কয়েকজন। প্রাণভয়ে
সবাই পানিতে নেমে যেতে বাধ্য হয়। ছোট্ট সন্তানের কথা ভেবে মায়াবতী প্রথমে কিছুটা ইতস্তত
করছিল, কিন্তু পরমুহূর্তেই সে ঝাঁপ দেয় নদীর শীতল পানিতে। একসময় নদীর ওপার থেকে লোকজন
এসে মাঝনদী থেকে তাদের উদ্ধার করে বটে, কিন্তু জ্বলতে থাকে গোটা মালোপাড়া।
প্রচণ্ড ভয়ে সে রাতে আর এপারে
ফেরা হয়না মালোদের। তারা ফেরে পরদিন সকালে। কিন্তু নিজেদের বাড়িঘর তারা নিজেরাই আর
চিনতে পারে না। লন্ড-ভন্ড হয়ে গেছে সবকিছু, সম্পত্তির সাথে স্বপ্নগুলোও। আগুনে পুড়ে
গেছে রঞ্জন মালোর সবক'টি জাল, দুলালীর গহনার বাক্স খালি, চুরি হয়ে গেছে শাড়ীগুলোও,
এমনকি কলাগাছগুলো পর্যন্ত দ্বিখন্ডিত হয়ে পড়ে আছে মাটিতে। এখন কিভাবে মাছ ধরা হবে,
কিভাবে অন্ন যোগাড় হবে, কিভাবেই বা মেয়েদের বিয়ে দেওয়া হবে সেসব কিছুই তাদের কারও জানা
নেই। তবে সবকিছু ছাপিয়ে এই প্রচণ্ড শীতে খোলা আকাশের নীচে তারা কিভাবে বেঁচে থাকবে
সেটাই বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে এই মালোদের সামনে।
৫.
ছিমছাম একটা বাড়ির দোতলার
একটা সুন্দর রুমে বসে অরিন্দম নামের এক সস্তা লেখক ল্যাপটপের স্ক্রিণে মালোপাড়ার খবরটা
পড়ছিল। এই চরিত্রগুলোকে তার খুব চেনা মনে হয়। এ তো তার পরিচিত কাহিনী, এই মানুষগুলোর
গল্প তো অনেক আগেই বলা হয়ে গেছে বহুবার। কিন্তু গল্পটা সে যে কোথায় শুনেছে সেটা ঠিক
মনে করতে পারে না। এসব ভাবতে ভাবতে সে কয়েকটা লাইন লিখে ফেলে এবং তারপর সেটাকে ফেসবুকে
পোষ্ট করে দেয়। এর কিছুক্ষণ পর তার ঘুম পায় এবং প্রশস্ত কোমল বিছানায় লেপ মুড়ি দিয়ে
আরামদায়ক উষ্ণতায় সে ঘুমিয়ে পড়ে। কিন্তু মালোপাড়ায় উষ্ণতার কোন দেখা নেই, হু হু করে
হিমশীতল বাতাস বয়ে যায় আত্রাই নদীর ধার দিয়ে। মায়াবতীর কোলে জাপটে ধরে রাখা ছোট্ট শিশুটির
নরম গালদু'টিতে টুকটুকে লাল হয়ে রক্ত জমে থাকে।।
অরিন্দম গুস্তাভো বিশ্বাস
০৯ ― ১৩ জানুয়ারী ২০১৪
খুলনা
ঋণস্বীকারঃ
১. প্রদোষে প্রাকৃতজন ― শওকত আলী
২. তাজউদ্দীন আহমদের ডায়েরি,
১৯৪৯ - ১৯৫০
৩. কালের কণ্ঠ
৪. ছবিঃ শেষ ট্রেন, ঢাকা থেকে কলকাতা, ১৯৪৭
ক্যামেলিয়া'র চিঠি প্রথম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা, ফেব্রুয়ারি ২০১৪ তে প্রকাশিত
৩. কালের কণ্ঠ
৪. ছবিঃ শেষ ট্রেন, ঢাকা থেকে কলকাতা, ১৯৪৭
ক্যামেলিয়া'র চিঠি প্রথম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা, ফেব্রুয়ারি ২০১৪ তে প্রকাশিত