পৃষ্ঠাসমূহ

৬ জানু, ২০১৩

মান্টোর চোখে নৈরাজ্যময় দেশভাগ


আমরা ভাগ্যবান যে মান্টো একজন লেখক এবং পর্যবেক্ষকের দৃষ্টি দিয়ে বোম্বেতে বসে দেশভাগের সময়টাকে দেখেছেন। ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্তিলাভের জয়ধ্বনির আড়ালে ঢাকা পড়ে যাওয়া সেইসব সঙ্কটময় দিনগুলোর হালচাল আর ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে খুব অল্পই জানা যায়। কিছুটা জানা যায় এমসি চাগলা নামের একজন বিচারকের আত্মজীবনীতে, কিছুটা রফিক জাকারিয়ার লেখায়। কিন্তু, মান্টোর সরল বর্ণনায় সেইসব দিনগুলো যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে। ভারতীয়রা অনুভব করতে পারবে না যে সেই সময় তাদের শহরগুলো কতটা বিভক্ত ছিল এবং এই লেখা তাদের বিস্মিত করবে।

আবার পাকিস্তানে তাঁর অভিজ্ঞতার আলোকে মান্টো আমাদের বলেন, পুরো ব্যাপারটা কতটা মূর্খতায় পরিপূর্ণ ছিল। এই লেখাটি প্রকাশিত হয়েছিল 'উপার, নিচে অর দারমিয়া' নামের ১৯৫৪ সালের একটি সংকলনে।

পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস(Yom-e-Istiqlal), লেখক সা'দাত হাসান মান্টো


ভারত যখন ভাগ করা হয়, তখন আমি বোম্বেতে ছিলাম। রেডিওতে আমি কায়েদ-এ-আজম জিন্নাহ এবং পন্ডিত নেহেরুর ভাষণ শুনলাম এবং দেখলাম কিভাবে সারা শহরে নৈরাজ্য ছড়িয়ে পড়ল।

এর আগে, প্রতিদিন আমি খবরের কাগজে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার কথা পড়তাম। একদিন পাঁচজন হিন্দুকে কেটে ফেলা হত, আবার অন্যদিন পাঁচজন মুসলমানকে। সেই সময় দুই পক্ষেই সমান রক্তপাত হয়েছিল বলে আমার ধারণা, সেটা যে ব্যাপারেই হোক না কেন।

কিন্তু এখন, দেশভাগের সময়ে, অবস্থাটা ছিল ভিন্ন।

একটা গল্পের মাধ্যমে বলি।

খবরের কাগজওয়ালা প্রতিদিন আমার রান্নাঘরের জানালা দিয়ে 'টাইমস অফ ইন্ডিয়া' ছুঁড়ে দিয়ে যেত। হঠাৎ একদিন, একটি দাঙ্গার পর, কাগজওয়ালা আমার দরজায় এসে টোকা দিল।

আমি কিছুটা ভয় পেলাম। বাইরে বেরিয়ে এসে আমি কাগজ হাতে দেখতে পেলাম একজন অপরিচিত লোককে ।

আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলামঃ 'প্রতিদিন যে কাগজ দিয়ে যায় সেই লোকটি কোথায়?'

'সে মারা গেছে স্যার', লোকটি জবাব দিল, 'গতকাল কামাটিপুরায় তাকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। মারা যাওয়ার আগে, সে আমাকে কাগজ বিলি করার আর সেগুলোর মূল্য সংগ্রহের তালিকাটি দিয়ে গেছে'।

এটা শুনে আমার কেমন লেগেছিল সেটা আমি প্রকাশ করতে পারব না, তাই আমি সেটা করার চেষ্টাও করব না।

পরের দিন, আমি ছিলাম ক্লেয়ার রোডে, আমার বাড়ির কাছেই। সেখানে একটি পেট্রল পাম্পের কাছে একটা মৃতদেহ পড়ে ছিল। লোকটি ছিল একজন হিন্দু বরফ বিক্রেতা, তার ঠেলাগাড়িটি ছিল তার পাশেই। বরফ গলে পড়ছিল, বরফগলা পানির ফোঁটাগুলো রক্তের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে লোকটির চারিদিকে ঘন হয়ে জমে ছিল। সেটা দেখতে ছিল অনেকটা জেলির মত।

সে ছিল এক অদ্ভুত সময়। চারিদিকে ছিল নৈরাজ্য, হানাহানি, আতঙ্ক এবং এই অরাজকতার গর্ভ থেকে জন্ম হল দুইটি জাতির। স্বাধীন ভারত ও স্বাধীন পাকিস্তান।

বোম্বের বহু অবস্থাসম্পন্ন মুসলিমরা একটি ইসলামিক প্রজাতন্ত্রের জন্মের উৎসব দেখার আশায় করাচীর বিমানে চড়ে বসল। অন্যরা ভীতসন্ত্রস্ত অবস্থায় রয়ে গেল, তাদের প্রতি ভয়ংকর কিছু ঘটবে না এই আশায় বুক বেঁধে। এল ১৪ই অগাস্ট।

বোম্বে সবসময়ই একটি সুন্দর শহর ছিল, এখন তাকে দেখাতে লাগল জমকালো সাজে নববধূর মতন। উজ্জল আলোতে ঝলমল করছিল পুরো শহর, আলোকসজ্জা এত বেশী ছিল যে আমার ধারণা সেই রাতের মত বিদ্যুৎ খরচ আর কখনও করা হয়নি।

বোম্বে ইলেক্ট্রিক সাপ্লাই এবং ট্রামওয়ে কোম্পানি(বিইএসটি), তাদের একটি ট্রামগাড়িকে সাজিয়েছিল উৎসবের সাজে। কংগ্রেসের তিনটি রঙের সাথে সাদৃশ্য রেখে তারা পুরো গাড়িটিতে আলোকসজ্জা করেছিল এবং এটা পুরো শহরে ঘুরে বেড়িয়েছিল সারারাত।

বহু দালানও আলোকসজ্জায় আলোকিত ছিল, বিশেষ করে হোয়াইটওয়েজ(Whiteways) এবং ইয়ান ফ্রিজেস(Ewan Frieze’s) এর মত ব্রিটিশ মালিকানার দোকানগুলি।

এবার শোনা যাক ভিন্ডী বাজারে কি হচ্ছিল। এটি একটি বিখ্যাত বাজার এলাকা যেখানে, বোম্বের ভাষায় যাদের বলা হত 'মিয়া ভাই', তাদের আধিপত্য প্রবল ছিল। তারা ছিল মুসলিম।

পুরো এলাকাটা অগুনতি হোটেল আর রেস্টুরেন্টে ভর্তি ছিল, কিছুর নাম ছিল 'বিসমিল্লাহ', কিছুর নাম 'সুবহানাল্লাহ'। কোরান শরীফের প্রায় পুরোটাই এইসব নামের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যেত।

ভিন্ডী বাজার ছিল বোম্বের পাকিস্তান। এখানে, হিন্দুরা উদযাপন করছিল হিন্দুস্তানের স্বাধীনতা এবং মুসলিমরা পাকিস্তানের।

এসবের মানে কি সে ব্যাপারে আমার আসলে কোন ধারণাই ছিল না।

ভিন্ডী বাজারের কিছু হিন্দু দোকানে তিন রঙ দেখা যাচ্ছিল। এছাড়া আশেপাশে যেখানেই তাকানো হোক, দেখা যাচ্ছিল মুসলিম লীগের ইসলামিক পতাকা। সকালবেলায় আমি যখন সেখানে গেলাম কেমন যেন অদ্ভুত লাগল আমার। সারা বাজার ছেঁয়ে গেছে সবুজ পতাকায়। কাঁচা হাতে আঁকা জিন্নাহর একটি ছবি সেখানকার একটা রেস্টুরেন্টে সাজানো ছিল। এই দৃশ্যগুলি আমি কখনোই ভুলতে পারি না।

পাকিস্তান পাওয়ার আনন্দে মুসলিমরা মাতোয়ারা ছিল। কিন্তু এই পাকিস্তান কোথায় ছিল? ভিন্ডী বাজারে তো নয়। আর এটা যদি ভারত না হয়, তাহলে পাকিস্তানটা আসলে কি? এই মুসলিমদের এটা জানা ছিল না।

তারা সবাই ছিল আনন্দিত, শেষমেষ আনন্দিত হওয়ার কোন কারণ পাওয়ার চাইতে হয়ত কারণহীনতাই তাদের আনন্দের কারণ ছিল। পাকিস্তান সৃষ্টির আনন্দে কাপের পর কাপ চা আর দেদারসে সিগারেট চলেছিল রামপুর দাদা রেস্টুরেন্টে।

যেমনটা আমি বলেছিলাম, আমার কোন ধারণাই ছিল না এসবের মানে কি। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হল, অগস্টের ১৪ তারিখ বোম্বেতে একটিও খুন-খারাপির ঘটনা ঘটেনি। সবাই তাদের স্বাধীনতা উদযাপন করতেই ব্যস্ত ছিল।

এই স্বাধীনতাটা আসলে কি, কিভাবে এটা এটা অর্জিত হল এবং তাদের জীবনে এর ভূমিকাটা কি হবে - এসব ব্যাপারে কারও কোন মাথাব্যাথাই ছিল না। ছিল শুধু গলাফাটানো স্লোগান। একপাশ থেকে 'পাকিস্তান জিন্দাবাদ', অন্যপাশ থেকে 'হিন্দুস্থান জিন্দাবাদ'।

এবার আমাদের নতুন ইসলামিক প্রজাতন্ত্রের ব্যাপারে কিছু শোনাই।

গতবছরের স্বাধীনতা দিবসে, একটা লোক আমার নিজের বাড়ির সামনের একটি গাছ কেটে ফেলছিল। আমি তাকে বললামঃ 'এটা আপনি কি করছেন? এই গাছটি কাটার কোন অধিকার আপনার নেই'। সে জবাব দিলঃ 'এটা পাকিস্তান। এটা আমাদের অধিকার'।

আমার কাছে এর কোন জবাব ছিল না।

দেশভাগের আগে একটা সময়, আমাদের বাড়ির আশপাশ অনেক সুন্দর ছিল। এখন সেখানকার বাগানটা শুকিয়ে গেছে আর সেখানে উলঙ্গ শিশুরা অরুচিকর খেলাধুলা এবং গালিগালাজ করে।

আমার একটা মেয়ের বড় একটি খেলার বল হারিয়ে গিয়েছিল, আমি ভেবেছিলাম যে এটা বাড়ির ভেতরেই কোথাও আছে কিন্তু পরে আমি সেটার কথা ভুলে গিয়েছিলাম। দিন চারেক পরে, আমি কয়েকটা ছেলেকে সেটা নিয়ে খেলা করতে দেখলাম। আমি এ বিষয়ে তাদের মুখোমুখি হলে তারা বললঃ 'এটা আমাদের। আমরা এক রুপি চার আনা দিয়ে এটা কিনেছি'।

আমি এটা কিনেছিলাম চার রুপি পনেরো আনা খরচ করে। কিন্তু আমি আমার ছোট্ট মেয়ের বলটাকে তাদের হাতেই ছেড়ে এলাম যেহেতু এর সন্ধানপ্রাপ্ত-মালিকদের অবস্থান পাকিস্তানের মধ্যে এবং এটাতে তাদের অধিকার আছে।

আমাদের মহল্লার আরেকটি গল্প। আমাদের বাড়ির রাস্তা থেকে একজন লোক ইট খুলে নিচ্ছিল। আমি বাইরে গিয়ে তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, 'আপনি আমাদের ক্ষতি করছেন কেন?' সে জবাব দিলঃ 'এটা পাকিস্তান- আমাকে থামাবার তুমি কে?'

এক্ষেত্রেও আমার কাছে কোন জবাব ছিল না।

একবার আমি একটি রেডিও সারাই করতে দিয়ে ভুলে গিয়েছিলাম। একমাস পরে যখন সেটার কথা আমার মনে পড়ল, তখন আমি সেটা আনতে গেলাম। লোকটি বললঃ 'আমি আপনার জন্য অপেক্ষা করেছিলাম, কিন্তু আপনি না আসায় মেরামতের খরচ তুলে আনতে সেটা আমি বিক্রি করে দিয়েছি।'

অতি সম্প্রতি, আমি সরকার থেকে একটি নোটিশ পেয়েছি। এটাতে লেখা ছিল, 'আপনি একজন অবাঞ্ছিত ব্যাক্তি। উদ্বাস্তু সম্পত্তি হিসেবে যে বাড়ি আপনাকে দেওয়া হয়েছে সেটা খালি করে দিন অথবা আমাদের বলুন আপনাকে উচ্ছেদ করা কেন উচিত হবে না'।

আমি যদি এখন একজন 'অবাঞ্ছিত ব্যাক্তি' ঘোষিত হতে পারি, হয়ত আমাকে ইঁদুর হিসেবে ঘোষণা দিয়ে তাড়িয়ে দেবার অধিকারও সরকারের আছে। যাইহোক, আপাতত আমি পাকিস্তানে নিরাপদেই আছি।

পরিশেষে আমি এই গুরুপ্তপূর্ণ ঘটনাটি বলতে চাই।

দেশভাগের পরে বোম্বে ছাড়ার পর, আমি প্রথম আসি করাচীতে। এখানকার অবস্থা তখন এতই খারাপ ছিল যে আমি তত্ক্ষণাৎ লাহোরে ভেগে যাবার সিদ্ধান্ত নিলাম। রেলস্টেশনে গিয়ে আমি লাহোর যাবার জন্য একটা ফার্স্ট ক্লাশের টিকিট চাইলাম।

টিকিট মাস্টার বললেনঃ 'সব সিট দখল হয়ে গেছে, আপনার জন্য কোন সিট নেই।'

আমি বোম্বের পরিবেশে অভ্যস্ত ছিলাম, যেখানে পয়সার বিনিময়ে সবকিছুই সহজলভ্য। তাই আমি বললাম, 'দেখুন, আপনি নিজের জন্য কিছু রেখে দিয়ে আমাকে টিকিটটা দিন।'
তিনি কাজ বন্ধ করে আমার দিকে তাকালেন। কঠোর গলায় বললেনঃ 'এটা পাকিস্তান। আগে হলে হয়ত আমি একাজ করতাম, কিন্তু এখন আমি এটা করতে পারি না। সব সিট দখল হয়ে গেছে, কোন মূল্যেই আপনি এখন আর টিকিট পাবেন না।'

এবং আমি সত্যিই পাইনি।।


অনুবাদঃ অরিন্দম গুস্তাভো বিশ্বাস
০৬ জানুয়ারী ২০১৩
খুলনা


লেখক পরিচিতিঃ সা'দাত হাসান মান্টো (মে ১১, ১৯১২ – জানুয়ারী ১৮, ১৯৫৫) ছিলেন একজন ভারতীয় উর্দূ ছোটগল্প লেখক যিনি দেশভাগের পর পাকিস্তানে চলে গিয়েছিলেন। তিনি সুপরিচিত তাঁর ছোটগল্পগুলোর জন্য- বু, খোল দো, ঠান্ডা গোশ্‌ত এবং তাঁর শ্রেষ্ঠ লেখা তোবা তেক সিং। দূর্ভাগ্যক্রমে বর্ডারের দুই পাশেই জীবন কাটানোর ফলে পাকিস্তানে তাঁকে বলা হয় ভারতীয় লেখক এবং ভারতে বর্ণনা করা হয় একজন পাকিস্তানী লেখক হিসেবে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তিনি ছিলেন রাস্ট্র ও ধর্মভিত্তিক প্রভেদের উর্ধ্বে অবস্থানকারী একজন লেখক। (বিস্তারিত)