আমরা তখন যশোরে
থাকি।
আমাদের বাসা
ছিল একটা
লম্বা গলির
ভেতরে।
বাবা অফিসে
যাওয়ার সময় আমরা ছোট্ট দুই ভাই-বোন ঐ
গলির মুখে
গিয়ে দাঁড়াতাম,
মা থাকতেন
বাসার গেটে। বাবার
মোটরসাইকেলটা চোখের আড়াল হয়ে যাওয়া মাত্রই
আমাদের দৌড়
শুরু হত। দৌড়ে প্রথম হয়ে
মা'কে
স্পর্শ করার
উদ্দেশ্যেই ছিল আমাদের ভাই-বোনের
মধ্যেকার এই
প্রতিযোগিতা। মা'কে জড়িয়ে
ধরতে পারাই
ছিল এক
পরমানন্দের উপলব্ধি। আমার ছেলেবেলায়
প্রাচুর্য ছিলনা সত্যি, কিন্তু বহু
ছোট ছোট
আনন্দের উপাদানে
পূর্ণ ছিল
সময়টা।
সেই সময়টার
পুরোভাগে ছিলেন
আমার মা,
যাকে চাইলেই
কাছে পাওয়া
যেত, যার
কাছে ছিল
আমার সমস্ত
আবদার।
বাবাকে আমরা খুব
একটা কাছে
পাইনি।
জীবিকার প্রয়োজনেই
তাঁকে ব্যস্ত
থাকতে হত। মা'র জীবন
কাটতো ছোট্ট
একটা রান্নাঘরে। আমাদের
দুই ভাইবোনকে
মানুষ করাই
যেন ছিল
তাঁর জীবনের
লক্ষ্য।
সেই লক্ষ্য
অর্জনে তিনি
তাঁর জীবনের
সমস্ত কিছু
বিসর্জন দিয়েছিলেন। মা
একসময় খুলনা
বেতারের নিয়মিত
নজরুল সঙ্গীত
শিল্পী ছিলেন,
আমরা রেডিওর
পাশে আগ্রহ
নিয়ে বসে
থাকতাম মা'র গান
শোনার জন্য। আমাদের
রেখে যশোর-খুলনা যাতায়াত
করতে হবে
বলে মা
সেটাও ছেড়ে
দিয়েছিলেন।
এখন মাঝে
মাঝে নিজেকে
অপরাধী বলে
মনে হয়
স্বার্থপরের মত মা'র জীবনের
সমস্ত অর্জনগুলো
কেড়ে নিয়েছি
বলে।
আমার মা'র নামের অর্থ
করুনাময়ী।
যদিও ছোট
ছিলাম কিন্তু
একটা ঘটনা
আমার স্পষ্ট
মনে পড়ে। আমার
বাবার একটা
হালকা সবুজ
রঙের ডালপালা
আঁকানো পছন্দের
শার্ট ছিল। একদিন
এক ভিক্ষুক
এসেছিল যার
গায়ে দেবার
কিছু ছিলনা। আমার
মা অন্য
কিছু না
পেয়ে বাবার
সেই শার্টটাই
তাকে দিয়ে
দেন।
বাবা অফিস
থেকে ফেরার
পর মা
বলেন, 'আমি
একটা অপরাধ
করেছি, তুমি
রাগ করবে
না তো?'। ঘটনা
শোনার পর
বাবার উত্তর
ছিল, 'ভাল
করেছো, এখানে
আমার রাগ
করার কিছু
নেই'।
এখন সময়
অনেক বদলে
গেছে কিন্তু
এখনও বাড়ি
গেলে দেখি
মা'র
পরণের শাড়ী
দুই-এক
জায়গায় ছেঁড়া
অথবা সেলাই
করা।
এসব নিয়ে
আমাদের কোন
রাগারাগি আমার
মা কখনও কানে
তোলেন না
কিন্তু দেখা
যায় কোথাকার
কোন মহিলার
শাড়ী নেই,
কার লুঙ্গি
লাগবে এইসব
নিয়ে তাঁর
যত দুশ্চিন্তা। ভোগে
নয়, আমার
মা দান
করার মধ্যেই প্রকৃত সুখের সন্ধান
পেয়েছেন।
আমি আমার মা'র খুব
ন্যাওটা ছিলাম। ছোটবেলায়
আমার একটা
অভ্যাস ছিল
যে একটু
পর পর
মা'কে
জিজ্ঞাসা করতাম,
'আম্মু, তুমি
আমাকে ভালবাসো?'। আমার
মা ছোটখাট
উচ্চতার হলেও
তাঁর স্নেহ-মমতার বিশাল
আঁচলের তলে
আমাকে আগলে
রাখতেন।
উচ্চতায় মা'কে ছাড়িয়ে
গিয়েছি অনেক
আগেই কিন্তু
তাঁর ভালবাসার বিশালতাকে ছাড়িয়ে যাওয়া অসম্ভব।
তৃষ্ণার্ত আমি তাই বারবার মা'র কাছে
ফিরতে চাই,
একজন মানুষ হিসেবে আমি সবসময় তাঁর মত হতে চাই। বহুদিন এমন বলিনি,
এই দিনে
তাই ছোটবেলার
মত করে
বলি, 'আম্মু,
আমি তোমাকে
অনেক ভালবাসি। তুমি
আমাকে ভালবাসো
তো?'।।
অরিন্দম গুস্তাভো
বিশ্বাস
০২ ফেব্রুয়ারি ২০১৩
ঢাকা
সাপ্তাহিক বর্ষ ৫ সংখ্যা ৪০, ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ তে প্রকাশিত