পৃষ্ঠাসমূহ

২৭ জুন, ২০১৩

কিংবদন্তির বিদায়!

'এ্যাই তোর রোল নম্বর ৩১ ছিলনা?'

আমি ভ্যাবাচেকা খেয়ে যাই। আমতা আমতা করতে থাকি। স্কুল ছেড়েছি প্রায় ৬-৭ বছর আগে। রোল নম্বর কত ছিল সেটা তো মনে নাই।

'ক্লাশ নাইনে ৩১ ছিল তো নাকি?', স্যার আবারও জানতে চান।

এইবার আমার মনে পড়ে যায়। সেন্ট জোসেফস্‌ স্কুলে আমি যখন ভর্তি হই তখন ৩১ নম্বর রোলটা ফাঁকা ছিল তাই আমাকে সেটাই দেওয়া হয়েছিল। আমি স্যারের অসাধারণ স্মৃতিশক্তি দেখে অবাক হই।

এই ঘটনা প্রবাহের শুরু হয়েছিল বহুবছর আগে...

আমার বাবা ছিলেন সেন্ট জোসেফস্‌ এর ছাত্র। ছোটবেলা থেকেই বিভিন্ন সময় তাঁর মুখে স্কুলের গল্প শুনতাম। হাইয়ার ম্যাথের নিরাপদ স্যার, বাংলার বীরেন স্যার, পরিমল স্যার, জলধর স্যার, গ্যাব্রিয়েল স্যার, হেডমাষ্টার গ্যাব্রিয়েল মল্লিক স্যার...

বাবার খুব ইচ্ছা ছিল আমাকে সেন্ট জোসেফস্‌ এ পড়াবেন কিন্তু আমরা যশোরে থাকাতে সেটা আর সম্ভব হয়নি। তখন আমি পড়ি পুলিশ লাইন স্কুলে, ক্লাশ নাইনে মাত্র কয়েকমাস ক্লাশ হয়েছে। বাবার নতুন চাকরি তখন খুলনাতে তাই তিনি চাইলেন আমরা সবাই যেন সেখানে চলে আসি। এর ফলে আমার সুযোগ হল সেন্ট জোসেফস্‌ স্কুলে পড়ার। আমি যেহেতু যশোরে বড় হয়েছি তাই এই সিদ্ধান্ত আমি মোটেই পছন্দ করিনি। বাবা বলতেন, 'যে স্যারেরা আমাকে পড়িয়েছেন তাঁরা তোমার ক্লাশ নেবেন, তোমাকে অনেক আদর করবেন'। বলাবাহুল্য, এসবে আমার ভয় কাটেনি মোটেও।

খুলনাতে এসে দেখা পেলাম বিখ্যাত নিরাপদ স্যারের। ছোটখাট একজন শ্যামলাবর্ণের মানুষ। পাট করে আঁচড়ানো কাঁচাপাকা চুল। হালকা গোঁফ। আমার বাবাকে পড়িয়েছেন সেই হিসেবে আমি যেমন ভেবে রেখেছিলাম তার তুলনায় যথেষ্ট যুবক। কিছুদিন পর বুঝলাম স্যার আসলে চিরনবীন একজন মানুষ।

ক্লাস নাইনে আমি স্যারের কাছে পড়তে যেতাম। প্রতিদিন সকাল ৭টার দিকে। স্যারের বাড়ি ছিল জেলখানা ঘাটে নদী পেরিয়ে ঐপারে। জায়গাটার নাম খুব সম্ভব আইচগাতী, শাহাপাড়া। এত দূর থেকেই নদী পার হয়ে প্রতিদিন ভোরবেলা ঠিক সময়ে হাজির হতেন। হাতে ঝুলতো অফিস ব্যাগের মত খয়েরী রঙের একটা ব্যাগ। সেখান থেকে বেরুত ম্যাথের সাজেশন, ইংরেজী প্যারাগ্রাফের নোট, ফিজিক্সের ম্যাথের সল্যুশন ইত্যাদি অনেক কিছু। সবকিছুই ছিল হাতে লেখা এবং আমার স্পষ্ট মনে আছে স্যারের হাতের লেখা ছিল অসাধারণ। স্যারের সিগনেচারটাও আনকমন ছিল। বড় হাতের অক্ষরে লিখতেন ND, নিরাপদ দাস।

আমাদের স্কুলের বিপরীতে একটা পুরনো বাড়িতে স্যার পড়াতেন। দুই তলার একমাত্র ঘরে। সেই বিল্ডিং এর নীচের তলা বলতে কিছু ছিলনা। সিঁড়িটা ছিল বাইরে, সিঁড়ি দিয়ে উঠে নীল রঙের কাঠের দরজা। স্যার দরজা খুলে ভেতরে ঢুকেই জানালাগুলো খুলে দিতেন। ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ করে পুরনো জানালাগুলো খুলে যেত।

এরপর স্যার পড়ানো শুরু করতেন। স্যার অনেক ক্লাশের ছেলেদের একসাথে পড়াতেন। আমরা ছিলাম নাইনে, টেনের কয়েকজন আসত। ক্লাশ এইট, সেভেন তো ছিলই। ক্লাশ থ্রী-ফোরের একটা পিচ্চিও ছিল। এত ছোট ক্লাশ স্যার পড়াতেন না কিন্তু যতদূর মনে পড়ে এই পিচ্চির বাবাও স্যারের ছাত্র ছিলেন এবং তাঁর বিশেষ অনুরোধে স্যার ঐ একজনকেই পড়াতেন। এত হরেক ক্লাশের ছাত্র স্যার কিভাবে একসাথে পড়াতেন সেটাও এক অদ্ভুত ব্যাপার। একই সময়ে কাউকে হয়ত ইংরেজী প্যারাগ্রাফের নোট মুখে মুখে বলে যাচ্ছেন, আমাদের দেখাচ্ছেন ফিজিক্স, ক্লাশ টেনদের হয়ত ম্যাথস। আবার কোন অংক কোন বইয়ের কত পাতায় আছে এসবও ছিল তার মুখস্থ।

স্যারের একটা বেশ লম্বা কঞ্চি মত ছিল। সেটা দিয়ে গুঁতো দিয়ে অমনোযোগী ছাত্রদের হুঁস ফেরাতেন। স্যারকে কখনও কাউকে সিরিয়াসলি মারতে দেখিনি। হয়ত মাঝে মাঝে হালকা বাড়ি দিয়ে বলতেন, 'কি হল? লিখিস না ক্যানো?'

আমি ছিলাম চরম ফাঁকিবাজদের একজন। তখন নতুন একটা সাইকেল কিনেছি। সাইকেল নিচে রাখতে হত বলে সেটা নিয়ে আমার বিশেষ টেনশন ছিল। তাই জানালার পাশে বসে বসে সাইকেল পাহারা দিতাম। স্যার বলতেন, 'ওরে বাইরে কি তোর? সাইকেল? পড়াশুনা তো কিছু করিস না তুই। অপুকে(আমার বাবা) এই কথা বললে যে কি হবে! রেজাল্ট খারাপ হলে বলবে স্যার আমার ছেলেটাকে কিছু পড়ায় নাই।'

স্যারের সাথে আবার দেখা হত স্কুলের ক্লাশে। স্কুলে স্যার পড়াতেন হাইয়ার ম্যাথ আর ফিজিক্স। মাঝে মাঝে স্যার বাবার কথা জিজ্ঞাসা করতেন। অনেক সময় আমার ছোটবোনের কথাও জানতে চাইতেন। বলতেন, 'ছোটটা কোথায় পড়ে? পড়াশুনা করে তো ঠিকমত?'। স্যার একবার আমাদের বাসাতেও বেড়াতে এসেছিলেন। অনেকের কাছে শুনতাম স্যার নাকি বিকাল ৪টায় স্কুল ছুটির পরেও প্রাইভেট পড়াতে বাসায় যান। খুব সম্ভব করোনেশন স্কুলের একটা মেয়েকে স্যার বাসায় গিয়ে পড়াতেন। বাড়িতে ফিরতেন সেই সন্ধ্যারাত্রে। সন্ধ্যার দিকে স্যারকে নাকি প্রায়ই জেলখানা ঘাট পার হতে দেখা যায়।

এস.এস.সি.'র পরে আমি ঢাকায় চলে আসি। স্যারের সাথে বহুদিন আর দেখা হয়নি। স্যারের সাথে আবার দেখা হয় এইচ.এস.সি.'র পরে। তখন কিছুটা ধূম্রশলাকার অভ্যেস রপ্ত হয়েছে। খুলনা ছোট্ট শহর, চেনা মানুষে ভরপুর। ধূম্রপান করার নিরাপদ জায়গা পাওয়া কঠিন। অনেক গবেষণা করে সাউথ সেন্ট্রাল রোডের এক কোণার একটা চায়ের দোকান সিলেক্ট করা হয়েছে। মানুষের চোখে পড়ার সম্ভাবনা কম। তো এমনই একদিন আমরা ধূম্রসেবন করে শলাকার অবশিষ্টাংশ মাত্র ছুঁড়ে ফেলেছি। মোড় ঘুরেই স্যারের আগমন, একই ফুটপাতে, আমাদের সামনেই। হাতে সেই পুরনো ব্যাগ, চোখে সেই পুরনো চশমা। আমি, পিজন, বিল্লু, রনি, উত্তম - আমরা সবাই সেন্ট জোসেফস্‌ এর ছাত্র। স্যার আমাদের সবার কথা জিজ্ঞেস করলেন। কোথায় ভর্তি হব এসব জিজ্ঞাসা করলেন। বাবার কথাও জানতে চাইলেন। স্যার চলে যাবার পর আমরা ভাবলাম, এই জায়গাটাও নিরাপদ না, স্যার হয়ত এইখান দিয়ে প্রতিদিনই আসা-যাওয়া করেন। আমাদের ধারণা অমূলক ছিল না কিন্তু দেখা গেল স্যার আর এই ফুটপাত দিয়ে আসেন না। মোড় থেকে রাস্তা পার হয়ে গিয়ে রাস্তার ওপাশের ফুটপাত দিয়ে যান। স্যার হয়ত কিছু টের পেয়েছিলেন তাই আমাদের আর লজ্জায় ফেলতে চাননি।

স্যার রিটায়ার করেছিলেন মনেহয় ২০০৬ বা ২০০৭ সালে। সার্টিফিকেট তোলার পরে আমিও আর স্কুলে যাইনি কোনদিন। স্যারের সাথে শেষ দেখা হয়েছিল বছর তিন-চার আগে। থানার মোড়ে স্বপনের দোকানে আড্ডা দিচ্ছিলাম। স্যার পাশ দিয়েই যাচ্ছিলেন। তাড়াতাড়ি গিয়ে দেখা করলাম। স্যার আমার রোল নাম্বার মনে করে আমাকে অবাক করে দিলেন। চা খাবেন নাকি জানতে চাইলাম। জানালেন আপত্তি নেই। সমুচা-সিঙ্গারা কিছুই খাবেন না, পরে বিস্কুট খেলেন। স্কুলের কথা বললেন। এখন ছাত্র পড়িয়ে বাড়ি ফিরছেন। এমন নানান আলাপ করে স্যার বিদায় নিলেন। যাওয়ার আগে বলে গেলেন, 'ভাল থাকিস তাহলে'।

খবরটি পেলাম গতকাল(২৫ জুন, ২০১৩) দুপুরে। বন্ধু ইমরান এর ফেসবুক স্ট্যাটাসে। হঠাৎ করেই। হেড স্যার, গ্যাব্রিয়েল স্যার, জলধর স্যার সবাই না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছেন বেশ কয়েক বছর আগেই। এবার প্রাক্তন সহকর্মীদের সঙ্গী হলেন নিরাপদ স্যারও। আমি মাত্র দুই সপ্তাহ আগে খুলনা থেকে ফিরেছি। স্কুলের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় পুরোনো বিল্ডিংটা দেখে মনে পড়েছিল নিরাপদ স্যারের কথা। ওখানে এখন অন্য কিছু হয়েছে খুব সম্ভব। জানালায় থাই গ্লাস, ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ করা নীল রঙের সেই কাঠের জানালাটা আর নেই। তাই হয়ত স্যারও আর থাকলেন না।

আমি বাবাকে ফোন দিলাম। কিছুক্ষণ পর বাবা খোঁজ নিয়ে জানালেন ঘটনা ঘটেছে সকালে। স্যার আগে থেকেই কিছুটা অসুস্থ্য ছিলেন। হার্টে রিং পরানো হয়েছিল। ডাক্তার বলেছিলেন বিশ্রামে থাকতে। কিন্তু স্যার তা শোনেননি। বাবা বললেন, 'একটা যুগ যেন শেষ হয়ে গেল'। আমি বললাম, 'কিংবদন্তির বিদায়'।

স্যার ছিলেন প্রচন্ড প্রাণশক্তিতে ভরপুর একজন মানুষ। স্যারকে কখনও রিক্সায় চড়তে দেখিনি। আমার বাবাও দেখেননি। তিনি সারাজীবনই হেঁটে চলাফেরা করতেন। স্যার অকৃতদার ছিলেন। ছাত্র-ছাত্রীরাই ছিল তার সবকিছু। গত কয়েকদশক তিনি যে রুটিন মেনে চলেছেন সেটা ভেঙ্গেচুরে ডাক্তারের কথামত বিশ্রামে গিয়ে অথর্ব হয়ে বেঁচে থাকাটা বোধকরি স্যারের জন্য কঠিন ছিল। তাই হয়ত ঝুঁকির কথা জেনেও শেষ সময়টুকু নিজের আনন্দভূবনেই বাঁচতে চেয়েছিলেন।

খবরটি শোনার পর থেকে মনটা খারাপ হয়ে আছে। সেন্ট জোসেফস্‌ স্কুল নিয়ে একটা গান আছে সেটা শুনছিলাম। কিন্তু কিছুতেই স্বাভাবিক হতে পারছি না। আমি খুব বাস্তববাদী একজন মানুষ। কেউ চিরকাল থাকবে না, সবাইকে চলে যেতে হবে - এইসব আমি খুব ভালো করেই বুঝি এবং মানি। কিন্তু কোন যুক্তিতেই কাজ হচ্ছে না, আমি ক্রমাগত ভেতরে ভেতরে পুড়ছি। এটা ভাবতে ভাবতে স্যারের কথাই আবার মনে পড়ল। স্যার একবার ক্লাশে বলেছিলেন, Time is the best healer. হয়ত ওটাই চূড়ান্ত কথা। সময়ে সয়ে যাবে সবকিছু।

আমার ব্যাচমেট কিছু বন্ধুরা, যারা একদম ছোটবেলা থেকে সেন্ট জোসেফস্‌ এ পড়েছে, ওরা প্রতি ঈদে স্কুলে জড়ো হয়। এইটা ওদের একটা অলিখিত নিয়ম। গতকাল ইমরানের একটা ফেসবুক পোষ্ট থেকে জানতে পারলাম স্যারও প্রতি ঈদে আসতেন ওদের সাথে দেখা করতে। বন্ধু ইমরান এই ছবিটা দিয়ে লিখেছে, 'এই ছবিটা গত রোজার ঈদের দুই/এক দিন আগে নেওয়া...এবারও হয়ত আমরা এক সাথে হব...কিন্তু স্যারকে আর পাওয়া যাবে না...'। আরেক বন্ধু গাজী শাওন লিখেছে যে ওর এলোমেলো চুল দেখে স্যার রাস্তার মধ্যেই পকেট চিরুনি বের করে ওর চুল আঁচড়ে দিতেন।

আমি, ইমরান, শাওন - কয়েকটি ক্ষুদ্র উদাহরণ মাত্র। এই জীবনে স্যারের কত হাজার-লক্ষ ছাত্র, তাদের প্রত্যেকের প্রতিনিয়ত স্মৃতিচারণে স্যার বেঁচে থাকবেন আরও অনেক অনেক বছর।

কত মানুষ এক জীবনে নিজেকে আলোকিত করতে পারেনা। স্যার আলোকিত করেছেন কয়েকটি প্রজন্মকে।

স্যারের প্রতি শ্রদ্ধা।।


অরিন্দম গুস্তাভো বিশ্বাস
২৬ জুন ২০১৩
ঢাকা