আর্নেস্তো চে’
গুয়েভারা (স্প্যানিশ উচ্চারণে ‘আর্নেস্তো
চে’ গেভারা’) ১৯২৮ সালের ১৪ই জুন আর্জেন্টিনার
রোসারিওতে জন্মগ্রহন করেন। তার বাবার নাম আর্নেস্তো গুয়েভারা লিঞ্চ এবং মা’র নাম সেলিয়া দে লা সারনা।
১৯৪৮ সালে তিনি ইউনিভার্সিটি
অফ বুয়েনস্ আয়ার্স এ চিকিৎসাশাস্ত্রে পড়াশুনা শুরু করেন। কিন্তু তার ছিল এ
পৃথিবীকে জানার ইচ্ছা। তার প্রথম অভিযান ছিল ১৯৫০ সালে ৪৫০০ কিলোমিটার (২৮০০ মাইল)
এর একটি যাত্রা। একটি ছোট মোটর লাগানো সাইকেলে করে তিনি একাই উত্তর আমেরিকার
গ্রাম্য প্রদেশগুলো ভ্রমণ করেন। ১৯৫১ সালে নয়মাস ব্যাপী দ্বিতীয় অভিযানে তিনি পাড়ি
দেন ৮০০০ কিলোমিটার (৫০০০ মাইল)। এই অভিযানে তার সঙ্গী ছিলেন তার বন্ধু আলবার্তো
গ্রানাদো। তারা দু’জন মোটরসাইকেলে করে
পাড়ি দেন আর্জেন্টিনা, চিলি, পেরু, ইকুয়েডর, কলম্বিয়া, ভেনেজুয়েলা, পানামা এবং
মায়ামি’র ভেতর দিয়ে সাউথ
আমেরিকার প্রায় সবটুকু। এই অভিযানের কাহিনীই বিখ্যাত ‘মোটরসাইকেল ডায়েরি’
নামে পরিচিত।
পড়াশুনা শেষ করে ১৯৫৩
সালের ৭ই জুলাই, চে’
আবার অভিযানে বের হন। এবার তিনি ভ্রমণ করেন বলিভিয়া, পেরু, ইকুয়েডর, পানামা,
কোষ্টারিকা, নিকারাগুয়া, হন্ডুরাস, এল সালভাদর। এই অভিযানে ১৯৫৪ সালে যখন তিনি
গুয়াতেমালাতে ছিলেন, তিনি দেখলেন কিভাবে প্রেসিডেন্ট জ্যাকভ আরবানেজ গুজম্যান এর
সমাজতান্ত্রিক সরকারকে আমেরিকার সাহায্যপুষ্ট একটি সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে
উৎখাত করা হয়। এটা দেখে তিনি সিদ্ধান্ত নেন মেক্সিকোতে কিউবান বিপ্লবী ফিদেল
ক্যাষ্ট্রোর সাথে যোগ দেবার।
১৯৫৬ সালে চে’ গুয়েভারা, ফিদেল ক্যাষ্ট্রো এবং ৮০
জনের একটি দল কিউবায় পৌঁছায় জেনারেল ফুলজেন্সিও বাতিস্তা’র একনায়ক সরকারকে উৎখাত করার উদ্দেশ্য নিয়ে। এই দলটি পরবর্তীতে
পরিচিত হয়ে ওঠে ‘জুলাই টুয়েন্টিসিক্স
মুভমেন্ট’ নামে। তাদের
পরিকল্পনা ছিল ‘সিয়েরা মায়েস্ট্রা’ পর্বতে বেস স্থাপন করার। পথে সরকারি
বাহিনী কর্তৃক আক্রান্ত হওয়ায় তারা মাত্র ১৬ জন আর ১২টি অস্ত্র নিয়ে সেখানে
পৌঁছাতে পেরেছিলেন। পরবর্তী কিছু মাসে অবশ্য ফিদেল ক্যাষ্ট্রোর গেরিলা বাহিনী
বিভিন্ন সামরিক রক্ষীনগরী আক্রমণ করে ধীরে ধীরে তাদের সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করতে
সমর্থ হয়।
যখনই গেরিলারা কোন
এলাকা দখল করত, তারা সেখানের জমিগুলো ছোট চাষীদের মাঝে ভাগ করে দিত। বিনিময়ে
চাষীরা বাতিস্তা’র সেনাদের বিরুদ্ধে
গেরিলাদের সাহায্য করতো। মাঝে মাঝে চাষীরা ফিদেল ক্যাষ্ট্রোর দলে যোগ দিত। আস্তে আস্তে
অন্য পেশার সাধারণ মানুষও তাদের সাথে যোগ দিতে শুরু করে।
যুদ্ধ যতই এগুতে
লাগলো, চে’ ততোই সেটার
অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠতে লাগলেন তার সামর্থ্য, যোগ্যতা, কূটনীতি এবং ধৈর্যের
কারণে। গুয়েভারা স্থাপন করেন গ্রেনেড বানানোর ফ্যাক্টরী, রুটি বানানোর চুলা।
নতুনদের তিনি শিখাতেন যুদ্ধের বিভিন্ন কৌশল। পরিচালনা করতেন ক্লিনিক এবং
সংবাদপত্র। তিনি নিরক্ষরদের জন্য স্কুলও স্থাপন করেছিলেন। তিনি বলতেন, ‘যে দেশ লিখতে আর পড়তে জানে না, তাদের
ধোঁকা দেওয়া সহজ’। এ সময় ফিদেল
ক্যাষ্ট্রো তাকে ‘কমোন্দান্তে’(কমান্ডার) পদ দান করেন।
ফিদেল ক্যাষ্ট্রো
ছাড়া চে’ ছিলেন তাদের বাহিনীর
একমাত্র কমান্ডার। তিনি ছিলেন কঠোর নিয়মানুবর্তিতাপ্রিয় লোক যিনি কিনা মাঝে মাঝে
দলদ্রোহীদের হত্যা করতেন, পলাতকদের গণ্য করা হত বিশ্বাসঘাতক হিসেবে। ফলে সবাই চে’ কে তার নিষ্ঠুরতা এবং নৃশংসতার জন্য ভয়
করতো। এরপরও চে’ ছিলেন তার বাহিনীর
কাছে একজন শিক্ষকস্বরূপ। তিনি তার অবসর সময় তাদের সাথে কাটাতে ভালবাসতেন, তাদের
সাথে ঠাট্টা করতেন এবং তাদের গল্প-কবিতা পড়ে শুনিয়ে তাদের আনন্দদানের চেষ্টা
করতেন।
১৯৫৮ সালের জুলাই
মাসে শেষে, চে’ তার বাহিনী নিয়ে
১৫০০ সৈন্যের একটি দলকে পরাজিত করেন, যাদের পরিচালক ছিলেন বাতিস্তা’র জেনারেল কান্টিলো। তাদের পরিকল্পনা
ছিলো ফিদেল ক্যাষ্ট্রোর বাহিনীকে ঘিরে ফেলে মেরে ফেলা। এটা ‘ব্যাটেল অফ লাস মার্সিডিস’ নামে পরিচিত।
ডিসেম্বর মাসে চে’ ‘লাস ভিলাস’
অঞ্চল দখল করেন। কিছুদিনের মধ্যেই সেই অঞ্চলের রাজধানী ‘সান্তা ক্লারা’
ছাড়া বাকী সবটুকু তার দখলে এসে যায়। ১৯৫৯ সালের নতুন বছরের দিনে ‘ব্যাটেল অফ সান্তা ক্লারা’ জয়ের মাধ্যমে চে’ ‘সান্তা ক্লারা’
দখল করেন। তার পরের দিন চে’
হাভানা পৌঁছে রাজধানীর পূর্ণ ক্ষমতা নেন। ফিদেল ক্যাষ্ট্রো তার ছয় দিন পরে হাভানা
পৌঁছান।
ক্ষমতায় এসে ফিদেল
ক্যাষ্ট্রোর সরকার কিছু নিয়মের পরিবর্তন আনেন। এর মধ্যে ছোট চাষীদের মাঝে জমি
বিতরণ এবং সাদা ও কাল চামড়ার মানুষের বৈষম্য লোপ করা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
১৯৬০ সালে চে’ গুয়েভারা চায়না এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন সফর
করেন। ফিরে এসে তিনি দু’টি
বই লেখেন – ‘গেরিলা যুদ্ধ’ এবং ‘কিউবান
বিপ্লবী যুদ্ধের স্মৃতিকথা’।
এতে তিনি বলেন যে কিউবার বিপ্লবের মত সাউথ আমেরিকার অন্যান্য দেশেও বিপ্লব করা
সম্ভব। চে’ ১৯৬১-১৯৬৫ সাল
পর্যন্ত কিউবার শিল্পমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৫ সালের এপ্রিল মাসে ইস্তফা
দিয়ে প্রথমে কঙ্গো এবং পরে বলিভিয়ায় বিপ্লব সংগঠন করতে চলে যান।
বলিভিয়ায় যাওয়ার আগে,
তিনি তার পাচঁ ছেলে-মেয়েকে একটি চিঠি লেখেন তার মৃত্যুর পর পড়ার জন্য। চিঠিটি তিনি
শেষ করেন এভাবে ‘সবার আগে, পৃথিবীর যে
কোন জায়গায়, যে কারো বিরুদ্ধে, যে কোন অবিচার গভীরভাবে অনুভব করার জন্য সবসময়
নিজেকে প্রস্তুত রাখবে। এটা একজন বিপ্লবীর সবচেয়ে সুন্দর একটি গুণ’।
৭ই অক্টোবর, ১৯৬৭,
আমেরিকান সিআইএ’র সাহায্যে বলিভিয়ান
আর্মির হাতে বন্দী হন চে’।
হাত বাঁধা অবস্থায় চে’
কে ‘লা হিগুয়ের’ নামের একটি এলাকার স্কুলঘরে রাখা হয়। ৯
তারিখ সকালে বলিভিয়ান প্রেসিডেন্ট রেনে বারিয়েন্তস চে’কে মেরে ফেলার আদেশ দেন। চে’ কে হত্যা করার
আগে একজন বলিভিয়ান সেনা তাকে প্রশ্ন করেছিল যে তিনি নিজে বেঁচে থাকার কথা ভাবছেন
কিনা। চে উত্তর দিয়েছিলেন ‘না, আমি
বিপ্লবের অমরত্বের কথা ভাবছি’। সেদিন দুপুরে
তাকে হত্যা করা হয়।
চে’ কে হত্যা করার
পর, ১০ই অক্টোবর তার মরদেহ ভ্যালেগ্রান্দে নামক কাছের একটি গ্রামে নিয়ে যাওয়া হয়। এখানে
সাধারণ মানুষের দেখার জন্য তার দেহ রাখা হয় এবং ছবি তোলা হয়। আঙ্গুলের ছাপ পরীক্ষার
জন্য একজন মিলিটারি ডাক্তার চে’র হাত দুটো
কেটে রাখার পর বলিভিয়ান আর্মি অফিসাররা চে’র দেহ কোন
অজানা জায়গায় সরিয়ে ফেলেন এবং এ ব্যাপারে কোন তথ্য দিতে অস্বীকৃতি জানান।
১৯৯৫ সালের শেষের দিকে বলিভিয়ান জেনারেল মারিও ভার্গাস
প্রকাশ করেন যে চে’ গুয়েভারার দেহ ভ্যালেগ্রান্দের একটি বিমান-ক্ষেত্রের
কাছে আছে। এরপর থেকে এর সন্ধান করা শুরু হয়। ১৯৯৭ সালের জুলাই মাসে একটি গণকবরে ৭
টি দেহ খুঁজে পাওয়া যায় এবং এর মধ্যে একজনের হাত কাটা ছিল।
১৯৯৭ সালের ১৭ই অক্টোবর চে’ গুয়েভারার দেহ
সম্পূর্ণ সামরিক মর্যাদায় বিশেষভাবে নির্মিত একটি সমাধিসৌধে শায়িত করা হয়। এটি
কিউবান শহর ‘সান্তা
ক্লারা’তে, যেখানে তিনি
কিউবান বিপ্লবের চূড়ান্ত বিজয়ে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।।
অরিন্দম গুস্তাভো বিশ্বাস
০৮ অক্টোবর ২০১০
ঢাকা
তথ্যসূত্রঃ ইন্টারনেট