আমি ঢাকায় যে বাড়িতে থাকি তার আগে ও পরে দুইপাশেই বস্তি আছে। পরের বস্তির ওপাশে একটা দেয়ালের পরই ঢাকা এয়ারপোর্টের রানওয়ে। আমি কাজের ফাঁকে বারান্দায় অথবা জানালার কাছে বসে সেই বস্তির মানুষদের মুগ্ধ হয়ে দেখি। যাদের নিয়ে আমরা সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা প্রতিনিয়ত গলাবাজি করি সেই ‘নিম্নবিত্ত’ বিশেষণে বিশেষায়িত শ্রেনীটির জীবনযাত্রা আমি মফস্বলে বড় হয়েও এত কাছ থেকে দেখিনি কোনদিন, যা দেখতে পেয়েছি এই ইট-পাথরের ঢাকা শহরে এসে। সারাদিন বিমানের শব্দ, উঠছে-নামছে অবিরাম। ছোট বাচ্চারা বিমান দেখে দেয়ালের উপর উঠে হাততালি দেয়। বাড়ির মহিলারা কেউ ঝাঁড়ু বাঁধে, কেউবা পালে গরু। পুরুষদের কেউ রিক্সা চালায়, কারও আছে ছোটখাট ব্যবসা। মাঝে মাঝে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে তুমুল ঝগড়া বাঁধে, সেটা আবার মিটমাট করে দেন সেখানকার প্রবীণেরা। একটু বৃষ্টি হলেই জলাবদ্ধতার কারনে তাদের আর দুঃখের সীমা থাকে না, জলের মাঝেই বাস করতে হয় তখন। কিছু কিছু দিন দেখি ওপাশের বস্তির একটি ছেলে এপাশের বস্তির সামনে দাঁড়িয়ে অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে এদিক সেদিক তাকায়, কখনও বা অপ্রয়োজনে মনোযোগ দিয়ে মোবাইল টিপতে থাকে। একটু পরেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হয় যখন সলজ্জ ভঙ্গিতে একটি মেয়ে বের হয়ে এসে ছেলেটির সামনে দাঁড়ায়। বুঝতে পারি মন দেয়া–নেয়া চলছে তাদের। এদের জীবন দেখতে দেখতে আমাদের নিজেদের জীবনের অতি জটিল সব রসায়ন অতীব সহজ হয়ে আমার কাছে ধরা দেয়। আমি নস্টালজিক হয়ে ফিরে যাই আমার স্কুল জীবনের বাংলা বইয়ের পাতায়। জহির রায়হানের উপন্যাস ‘হাজার বছর ধরে’র নানান চরিত্রের ছাঁচে কি অবলীলায় বসে যায় আমার বাড়ির পাশের মানুষগুলো! কিন্তু এবার মনে হচ্ছে শুধু এই উপন্যাসটি নিয়ে আর ভাবতে হবে না, ভাবার জন্য আমি পেয়ে গেছি একটি নতুন মাত্রা। এবার অবশ্য আর উপন্যাস নয়, নতুন মাত্রাটি যোগ করল নির্মাতা তারেক মাসুদের সাম্প্রতিক চলচ্চিত্রঃ ‘রানওয়ে’।
রানওয়ে’র নাম প্রথম দেখেছিলাম একটি জাতীয় দৈনিকে, পরিচালক তারেক মাসুদ এই নামে একটি ফিল্ম বানাচ্ছেন এই খবরের সাথে ছিল একটি ছোট ছবি। পিছনে বিমান উড়ছে, সৌদি এ্যারাবিয়ান এয়ারলাইন্সের বিশাল বিমান। সামনে হেঁটে আসছে একটি ছেলে, বিমানের সাথে তুলনায় অতিশয় ক্ষুদ্র। প্রথম দর্শনেই ছবিটি দারুণ লেগেছিল। বাংলা ছবির পোষ্টারের ভীড়ে ভয়াবহ ব্যতিক্রম একটি তো বটেই।
ভাগ্যক্রমে এই ফিল্মটি দেখার সুযোগ হয়ে গেল গত ৬-৯ই জানুয়ারী খুলনা ফিল্ম ক্লাব আয়োজিত ৪ দিন ব্যাপি ‘এ রেট্রোস্পেকটিভ অফ ফিল্মস বাই তারেক এন্ড ক্যাথরিন মাসুদ’ এর শেষ দিনে। এখানে এসেই জানতে পারলাম যে জনাব তারেক মাসুদ নিজের প্রচেষ্টাতেই সারা দেশে ‘রানওয়ে’ দেখিয়ে বেড়াচ্ছেন, তারই অংশ হিসেবে এখন খুলনাতে এসেছেন। এখানে এসে একসাথে দেখার সুযোগ হল ‘আদম সুরত’, ‘কানসাটের পথে’, ‘মুক্তির গান’, ‘মুক্তির কথা’, ‘সে’, ‘নারীর কথা’ এবং ‘নরসুন্দর’ ফিল্মগুলি। শেষের দিন ‘রানওয়ে’ দেখার জন্য অডিটোরিয়ামের উপচে পড়া ভীড় ছিল লক্ষ্য করার মত। ফিল্মের আগে জনাব তারেক মাসুদের বলা কথাগুলোও ছিল অনেক অজানা প্রশ্নের উত্তর সম্বলিত। নিজের চেষ্টায় সারা দেশে ফিল্ম দেখিয়ে বেড়ানোর ব্যাপারে তিনি বললেন যে, ‘মাটির ময়না’ বানিয়ে তিনি অনেক এ্যাওয়ার্ড জিতেছেন সত্যি, কিন্তু সারা দেশের মানুষকে ফিল্মটি দেখাতে না পারায় উনার অনেক অভিমান। ‘রানওয়ে’র সাথে তিনি এটা হতে দেবেন না, আর সেইজন্যই তার এই প্রচেষ্টা।
রানওয়ে দেখে কেমন লাগল তা শব্দে প্রকাশ করা মুশকিল। ফিল্মটির প্রতিটি অংশ দেখে মুগ্ধ হয়েছি। ফিল্মের কথা বলার আগে প্রথমে একটা বড়সড় ধন্যবাদ জানাতে চাই চিত্রগ্রাহক মিশুক মুনীর-কে। অসাধারণ সব ফ্রেমকে ক্যামেরাবন্দী করার মুন্সিয়ানা তিনি বারবার করে দেখিয়েছেন সারাটা ফিল্ম জুড়েই। পেছনে বিমান সামনে হেঁটে আসছে রুহুল, অথবা পানির প্রতিবিম্বে পাড়ে বসা রুহুল আর উপরে উড্ডীয়মান বিমান, অথবা ছোট্ট একটি ছেলে বিমানের দিকে তাক করে গুলতি মারছে -এর মত অনেক ফ্রেম দীর্ঘদিন স্মরনে রাখার মত।
ফিল্মের গল্পটিও অতিমাত্রায় বাস্তব। এয়ারপোর্টের রানওয়ের পাশের একটি ঘরে বাস করে রুহুলের পরিবার। বাবা, মা, বোন ফাতেমা আর দাদাকে নিয়ে রুহুলের পরিবার। দাদা বৃদ্ধ, বোন কাজ করে একটি গার্মেন্টস্ এ আর মা ঋণ নিয়ে কেনা গরু-বাছুর পালেন। সহায় সম্পত্তি যেটুকু ছিল সেগুলো বেচে কিছুদিন আগে রুহুলের বাবা মধ্যপ্রাচ্যে পাড়ি দিয়েছেন কাজের আশায়। তারপর থেকে তার আর কোন খবর পায়নি রুহুলের পরিবার। রুহুলের পড়াশুনা মাদ্রাসার ক্লাশ টেন পর্যন্ত। রুহুল কর্মহীন ঘুরে বেড়ায়, এর জন্য ধিক্কারও জোটে প্রায়শঃই। তাই মামার জোরাজুরিতে মাঝে মাঝে সে মামার সাইবার ক্যাফেতে বসে ইন্টারনেট শেখে। এখানেই তার পরিচয় হয় আরিফের সাথে যে কিনা একটি জঙ্গী সংগঠনের সাথে যুক্ত। তার ব্যাক্তিত্বে মুগ্ধ হয়ে রুহুল তার সাথে মেশা শুরু করে। এরপর দ্রুত পরিবর্তন আসতে থাকে আদর্শবাদী রুহুলের চরিত্রে, ইসলামিক জঙ্গীবাদের উগ্র কার্যকলাপের মাঝে সে খুঁজে পেতে শুরু করে জীবনের অর্থ। তার ভেতরে এই তত্ত্ব এতই দৃঢ়ভাবে প্রোথিত হয়ে যায় যে, যখন ফাতেমার বান্ধবী ও সহকর্মী শিউলি; যাকে রুহুল মনে মনে বেশ পছন্দও করত, তাকে বলে যে তার বাবা একজন মাদকাসক্তের সাথে তার বিয়ে ঠিক করেছে, তখনও রুহুলের কোন বিকার হয় না। সে আল্লাহের পথে থাকার যুক্তি দিয়ে তাকে ফিরিয়ে দিতে দ্বিধা করে না। পরিবারের সাথেও সম্পর্ক খারাপ হতে থাকে রুহুলের। এভাবেই সে এগিয়ে যেতে থাকে একটি সংঘাতময় পরিণতির দিকে।
ফিল্মটি দেখতে দেখতে যখন শেষের দিকে চলে এসেছি, তখন আমি মোটামুটি ধারণা করে ফেলেছি কি হতে যাচ্ছে! কারণ আমার জানা ছিল যে, আমাদের সমাজে রুহুলের মত চরিত্রদের পরিণতি মৃত্যু অথবা জেলখাটা ছাড়া অন্য কিছু হতে পারেনা। কিন্তু নির্মাতা তারেক মাসুদ তার ফিল্মের আলাদা হওয়ার উপকরণটি লুকিয়ে রেখেছিলেন ঠিক এই জায়গাটাতেই। বাস্তবতার ভেতরে থেকেও একটি ফিল্মকে যে দারুণ একটি সমাপ্তি প্রদান সম্ভব সেটা মুগ্ধ হয়ে দেখলাম ‘রানওয়ে’ ফিল্মটির শেষ অংশে। বাইরে বের হবার পর এটা নিয়ে জনাব তারেক মাসুদের সাথে কথা বলতে গেলে তিনি বললেন, ‘আমি বুঝি না কেন সবসময় আমাদের জীবনের গল্প দুঃখ দিয়ে শেষ করতে হবে। আমি আমার মুভিতে আশাবাদী মানুষকে দেখাতে চেয়েছি’। ‘রানওয়ে’র শেষ অংশ সত্যিই আশাবাদী মানুষকে দেখাতে পেরেছে। সবকিছুর পরও যে মানুষ হাল ছাড়ে না, সবকিছু হারিয়েও যে সে স্বপ্ন দেখতে ভালবাসে, নতুন করে নতুন আশা নিয়ে সে যে বারবার বাঁচতে শেখে এটাই মূর্ত হয়ে ওঠে ‘রানওয়ে’র শেষ কয়েকটি দৃশ্যে। রানওয়ে যেন জীবনের পথ, আমাদের প্রতিদিনের উত্থান-পতনের মত সেখানে নির্দিষ্ট সময়ে ওঠে-নামে জীবনরূপী বিমান।।
অরিন্দম গুস্তাভো বিশ্বাস
৩০ মে ২০১১
ঢাকা
উৎসর্গঃ তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীর ― দু'জন আলোকিত প্রতিভা।