ঋত্বিক কুমার ঘটক।
কিংবদন্তি চলচ্চিত্র পরিচালক। ক্ষণজন্মা এই মানুষটি সারাজীবন বিপুল বাধার সাথে লড়াই
করে পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমা বানানোর সুযোগ পেয়েছিলেন মাত্র আটটি। অবশেষে বিদায় নিয়েছিলেন
একবুক অভিমান নিয়ে। সংশপ্তকের মত সেই বিদায় ছিল স্বীকৃতিবিহীন, সাথে সাথে কপর্দকশুন্য
অবস্থায়ও বটে। একজন শিল্পী হিসেবে শিল্পের প্রতি বিশ্বস্ততা নাকি পরিবারের জন্য অর্থনৈতিক
স্বচ্ছলতা― ঋত্বিকের মধ্যে
এই সিদ্ধান্তের টানাপোড়েন চলেছিল শেষ পর্যন্ত। যে আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্নে বিভোর ছিলেন,
তাঁর জীবনকালে সেটা আর বাস্তব হয়ে ওঠে না। তবু নিজের মধ্যে কি এক অদ্ভুত বিশ্বাস ছিল
যে একদিন প্রাপ্য স্বীকৃতি পাবে তাঁর শিল্পকর্ম, এমনকি তাঁর মৃত্যুর পরে হলেও।
সেই কৈশোরকাল থেকেই
জীবনে ট্র্যাজেডির শুরু। দেশভাগের ফলে মাতৃভূমি পূর্ববঙ্গ ছেড়ে কলকাতা চলে যাওয়া। এরপর
এই দুঃখ বয়ে নিয়ে বেড়িয়েছেন সারাজীবন। বারবার প্রকাশ করেছেন নাটক ও সিনেমার মাধ্যমে।
দুঁদে ছেলের মত শৈশব-কৈশোর কেটেছে পদ্মার ধারে। স্টীমারে শুয়ে মাতাল নদীর দাপটে দোল
খেতে খেতে; এঞ্জিনের ধস্-ধস্, সারেঙের ঘন্টি আর খালাসীদের বাঁও না মেলা আর্তনাদ শুনতে
শুনতে; আর পদ্মাপারী বাংলার টান মাখানো কথা বলতে বলতে। তাই পরবর্তীতে নিজের শিল্পের
মাধ্যমে পূর্ববাংলার মানুষের এই জীবনপ্রণালী খুঁজে ফিরেছেন তিনি। সন্ধান করেছেন সেই
জমির যার উপরে দাঁড়িয়ে সত্যিকারের গভীরকে ছোঁয়া যায়। তিনি বারবার বলতে চেয়েছেন― 'আমাকে ফিরে যেতে হবে আমার মায়ের গর্ভে, এ ভাষার
উৎস-সন্ধানে'। জীবনের যে বিচিত্র প্রবাহ দেখে তাঁর আজন্ম শৈশব কেটেছে সেটা মানুষকে
দেখাতে না পারার আক্ষেপ ছিল। পাবনা, রাজশাহী আর ময়মনসিংহের স্মৃতিবিজড়িত তরুণ ঋত্বিক
দেশভাগের ফলে দ্বিখন্ডিত বঙ্গভূমির কষ্টে পীড়িত হয়েছেন প্রতিনিয়ত। দলিল নাটকের সংলাপে
তাই তিনি লেখেন―
'বাংলারে কাটিবারে পারিছ, কিন্তু দিলটারে কাটিবারে পার নাই'।
ছোটবেলা থেকেই খুব
দুরন্ত ছিলেন ঋত্বিক। স্কুল পালাতেন প্রায়ই। বাড়ি থেকেও পালিয়েছেন দু-তিনবার। কানপুরে
একটা টেক্সটাইল মিলের বিল ডিপার্মেন্টে কাজ করেছেন বছর দুয়েক। নিম্নবিত্ত মজুরদের সাথে
ওঠাবসা আর তাঁদের জীবনকে জানার অভিজ্ঞতা হয় ঐ সময়টাতেই। সেখান থেকে ফিরে এসে আবার পড়াশুনা
শুরু, সাথে কিছু কবিতা লিখে শিল্পচর্চা এবং অবশেষে রাজনীতির শুরু। ঋত্বিকের নিজের ভাষায়―
'বাবা বলেছিলেন ম্যাট্রিক পরীক্ষাটা দিলে ইঞ্জিনিয়ার ফিঞ্জিনিয়ার হওয়া যায়, নইলে নাকি
মিস্তিরি হয়ে থাকতে হবে। হঠাৎ পড়াশুনায় মন এসে গেল এবং তারপর পড়াশুনার দিকেই মন থাকল।
এবং বাঙালী ছেলেদের যা বাঁধা এবং ফরাসীদেরও যা হয় শুনেছি যে ভেতরে একটা Creative
Urge দেখা দিলেই প্রথমে কবিতা বেরোয়, তা দু-চারটে অতি হতভাগা লেখা দিয়ে আমার শিল্পচর্চা
শুরু হল। তারপর আমি দেখলাম ওটা আমার হবে না, কাব্যির একলক্ষ মাইলের মধ্যে আমি কোনদিন
যেতে পারব না। তারপর হল কি, রাজনীতিতে ঢুকে পড়লাম। ৪৩-৪৪-৪৫, সে সময়কার কথা যাঁরা জানেন
তাঁরা জানেন যে সে সময়টা ছিল রাজনৈতিক ক্ষেত্রে দ্রুত পটপরিবর্তনের সময়'।
তখন তিনি মার্কসবাদী
রাজনীতির সক্রিয় কর্মী। এসময় চারিপাশে অন্যায়-অত্যাচার দেখে তার বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ
করার উদ্দেশ্যে গল্প লেখা শুরু। একটা Marxist ঘেঁষা ম্যাগাজিনও বের করে ফেলেছিলেন।
তারপর মনে হল গল্প দিয়ে মানুষকে নাড়া দেওয়াটা অনেক সময়ের ব্যাপার। 'আমার তখন টগবগে
রক্ত, Immediate reaction চাই'― ঋত্বিকের ভাষায় এমনই ছিল অনুভূতিটা। এইসময় 'নবান্ন'
নাটক দেখে মুগ্ধ হয়ে তিনি গণনাট্য সঙ্ঘে যোগ দিলেন। সেখানে নাটক লিখলেন, অভিনয় করলেন,
পরিচালনাও করলেন। একটা সময় নাটককেও অপর্যাপ্ত বলে মনে হল। ভাবনাটা এমন ছিল যে, নাটক
দিয়ে জমায়েত চার-পাঁচ হাজার মানুষকে নাড়া দেওয়া গেলেও সিনেমা দিয়ে লাখ লাখ লোককে একসঙ্গে
একেবারে Complete মোচড় দেওয়া সম্ভব। সিনেমা করার আগ্রহের শুরুটা এভাবেই, সিনেমার প্রতি
কোন আলাদা ভালবাসা থেকে নয়।
গণনাট্য সঙ্ঘের মাধ্যমে পরিচয়
হয় সুরমা দেবীর সাথে। প্রথমে প্রথমে ঋত্বিক তাঁকে Das Kapital নামে ডাকতেন। দুইজনই
পার্টির সাথে যুক্ত ছিলেন, নাটক নিয়ে পড়াশুনাও চলত একসঙ্গে। এভাবে ধীরে ধীরে ঘনিষ্ঠতা।
যুক্তি তক্কো আর গপ্পো সিনেমাতে ঋত্বিক বর্ণনা করেছেন এভাবে― 'অনেক আশা, অনেক বিশ্বাস, অনেক
উৎসাহ পুঁজি করে... প্রেমে পড়ে গেলাম'। এরপর নানান কারণে পার্টির সাথে সম্পর্ক খারাপ
হতে থাকে। তখন দুজনেই সবকিছু ছেড়ে 'গ্রুপ থিয়েটার' নামে একটি গ্রুপ গঠন করে নাটক করা
শুরু করেন।
এসময় বিহার সরকারের কিছু ডকুমেন্টরির
কাজ পেয়ে ঋত্বিক চলে যান বিহারে। এই সময় থেকে হবু স্ত্রীকে লেখা প্রতিটি চিঠিতে পরিচয়
পাওয়া যায় ঋত্বিকের প্রেমিক স্বত্ত্বার। এর সাথে আছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বর্ণনা আর
নিজেদের জন্য একটি সুখী জীবন গঠনের নানান স্বপ্নের কথা। এবং অবশ্যম্ভাবীভাবে মূর্ত
হয়ে ওঠে ঋত্বিকের ভেতরকার সেই দ্বান্দ্বিক মনোভাব― শিল্প নাকি অর্থ? কোনটির পেছনে ছুটবেন তিনি?
ওরাওঁ আর মুন্ডাদের মধ্যে
কাজ করতে করতে রাঁচী থেকে লিখছেন― 'চাকরির ব্যাপারে একটা সুরাহা হয়ে এসেছে। আমার কাজে এরা
অত্যন্ত খুশী। মনে হচ্ছে পুরো ছবি করার সুযোগ কলকাতাতে ফিরেই পাব। দেখা যাক। অন্ততঃ
বিয়ে করে সংসার খরচ চালানোর জন্যে খুব দুশ্চিন্তা না করলেও চলবে। ... তোমার শ্রীহস্তের
দুছত্র লিপি এখন তৃষিত চাতকের ফটিক জলের মত'।
মাঝে মাঝে যখন অদ্ভুত অনুভূতি হয়, নিজেকে অসহায়-একলা লাগে। ছেলেবেলায় ফিরতে ইচ্ছা করে আর আশেপাশের কিছুই ভাল লাগে না, তেমনই কোন এক সময়ে দেওঘর থেকে লিখছেন―'নিজেকে
বড়
পূর্ণ লাগে যখন ভাবি, আমার চিন্তার সাথী একজন আছে, যে আমার সবচেয়ে উদ্ভট সবচেয়ে আজগুবী মনোভাবকেও পরম স্নেহের আলো দিয়ে বুঝতে পারে। আমি নিজেকে উদঘাটিত করতে পারি একটি লোকের কাছে, আজ তাই আমার অনুভূতি আনন্দ এনে দিচ্ছে। তোমাকে পাওয়াটা বড় ভীষণ ব্যাপার হয়ে গেছে আমার জীবনে। আমি এবার নিশ্চিন্ত। আমি আর কিছু চাই না'।
এর সপ্তাহখানেক পরে
লিখছেন পাটনা থেকে― 'কাজকর্ম ভবিষ্যতে Documentary তো পাবই। মনে হয়
একটা feature film-এরও chance অদূর ভবিষ্যতে মিলবে। ঠিকমত গুছিয়ে নিতে পারলে আর্থিক
সংকট থেকে মোটামুটি পরিত্রাণ পাওয়া যাবে। ... বেকার জীবনের ধিক্কার পেরিয়ে এমন আনন্দপুরী
আমার জন্য বিরাজ করবে সেটা কি আমি জানতাম? এইটুকু বলতে পারি, এই সুযোগটুকু যদি পাই,
চুটিয়ে বাঁচব এবার। কি করে মানুষ হতে হয়, কি করে জীবনকে সার্থক করে তুলতে হয়, কি করে
নিজেকে সম্পূর্ণ বিলিয়ে দিতে হয় দেশের মানুষের জন্য কাজের মধ্যে, সৃষ্টির মধ্যে, তার
পুরো রহস্যটা এবার জেনেছি'। এখানে একটা ব্যাপার উল্লেখ্য যে প্রথম চলচ্চিত্র 'নাগরিক'
তৈরী করা হয়ে গেছে বছর তিনেক আগেই, কিন্তু সেটা মুক্তি পায়নি। এই দুঃখটা বোধহয় ছিল
মনের মধ্যে। তাই প্রায়ই একটা Feature Film করার সুযোগের কথা বলতে দেখা যায়। এছাড়াও
বারবার লিখছেন অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতার স্বপ্নের কথা।
এরপর ফিরে এসেছেন
কলকাতায়। বিয়ের সময় এগিয়ে আসছে। কিন্তু আশেপাশের অনেকেরই ধারণা সুরমা দেবীর ঋত্বিককে
বিয়ে করার সিদ্ধান্তটা ভুল। নিজের জীবনকে ব্যাখ্যা করছেন এভাবে―
'আমি সৎ থাকার চেষ্টা করেছি আমার চিন্তায়, আমার লেখায়, আমার আনুগত্যে। বিয়ের পর এ জগৎ
থেকে দূরে চলে যাব কিছু কালের জন্য। স্তিমিত শান্ত জীবনের প্রতি অদ্ভুত শ্রদ্ধা হচ্ছে।
আমার পথ আমি জানি, জনতাকে সেবার পথ আমার সোজা, সে পথ এই ক্লেদ আর পরশ্রীকাতরতার মধ্যে
দিয়ে নয়। স্তিমিত জীবনের মাঝেই সৃষ্টিশীল সে জীবন'। নতুন জীবনে প্রবেশের দ্বারপ্রান্তে
দাঁড়িয়েও শিল্পের প্রতি যে বিশ্বস্ততা, শিল্পের মাধ্যমে মানুষের কথা বলার যে দায়বদ্ধতা,
এতসব সামাজিক-অর্থনৈতিক বাধা সত্ত্বেও সেটা অটুট ছিল।
বহুবছরের বোহেমিয়ান
জীবনযাপন, পার্টি-গণনাট্য সঙ্ঘের পেছনে খেটে যৌবনের একটা অংশ খরচ করে ফেলা, অর্থনৈতিক
ব্যাপারটা কখনও ভেবে না দেখা― এতসব কিছু মিলিয়ে অবশেষে এখন জীবনের একটা নতুন
অধ্যায়ের প্রারম্ভে ঋত্বিকের বক্তব্য― 'পরিষ্কার মনে হচ্ছে আজ জীবনের পরিপূর্ণ ছন্দবদলের
দরকার হয়ে পড়েছে। বাঁচতে হলে productive members of society হতে হয়, এটা বুঝিইনি। জীবন
গড়ব ভেবেছি, কিন্তু তার ভিত্তি যে উপার্জন ক্ষমতা, সেটা একদম বুঝিনি। এর ওপর এক মারাত্মক
ambition আমায় ছন্নছাড়া করে নিয়ে বেড়িয়েছে। জীবনের কাছ থেকে অনেক চাহিদা নিয়ে আমি রওয়ানা
হয়েছিলাম। সর্বশ্রেষ্ঠ হব, এই ছিল দম্ভ। সবসময় স্বপ্ন দেখেছি, দেশে নয়―
আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে জানা লোক হব। হায়রে, নিজের ক্ষমতাকে এত মূল্য দেওয়ার ফলে আজ এইখানে
এসে দাঁড়িয়েছি। মুখে এটাকে অনেক সময় অস্বীকার করেছি, আজও হয়ত করি, কিন্তু চাপা আগুনটা
এতদিন থেকেই গেছে। পথটা হিসেব না করে লক্ষ্যটাকে দেখেছি, তাই এত হোঁচট খাই। এবারে একটু
পথটাকেই দেখতে হবে। ... আমাদের অতীতের পাঁচ-ছয় বছরের সঙ্গে সব সম্পর্ক সত্যি সত্যি
চুকিয়ে দিতে হবে'।
ঋত্বিকের চরিত্র অনেক
সময় দেখা যায় একদম সহজ সরল, অনেকটা শিশুর মত। বিয়ের মাত্র ক'দিন আগে বোম্বের ফিল্মিস্তান
স্টুডিওতে চাকরির প্রস্তাব আসার পর একটি চিঠির এই অংশে ফুটে উঠেছে এক ঝলকে সমস্ত কিছু
ঠিক করে ফেলার এক আপ্রান আকুতি। অনেকের কাছে ঋণের দায়ে ডুবে ছিলেন আগে থেকেই কিন্তু
কল্পনার ডানায় ভর দিয়ে ঋত্বিক যেন এক মূহূর্তে পৌঁছে যেতে চান স্বপ্নের বন্দরে―
'একটু কাজের কথা শোনো। কোথাও কিছু নেই, হঠাৎ সলিল চৌধুরী বোম্বে থেকে এক টেলিগ্রাম
করেছে, Filmistan Job almost fixed. Passage, Hotel expense free. Start
immediately! একবছর আগে একটা casual কথা হয়েছিল, তারপর দুম্ করে এই তার। ফিল্মিস্তান
ভারতের সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান আজ। হাতে একটা পয়সা নেই যে তার করি। তারপর এখন তার করেছি,
যদি তুমি প্লেনের ভাড়া পাঠাও তার করে, তবে ২ তারিখে গিয়ে ৫ তারিখের মধ্যে কলকাতায় ফিরতে
পারি। Contract করে এসে fly করে শিলং গিয়ে বিয়ে করে আবার ১৫ তারিখ নাগাদ join করতে
পারি। তোমাকে সঙ্গে নিয়ে মাসখানেক গিয়ে বোম্বেতে থেকে আসতে পারি। Contract হলে মোটা
টাকা এখনই পাব, সংসার পাতার দুশ্চিন্তা থাকবে না। সব ধার মার ভূপতির বাড়ী পর্যন্ত পরিষ্কার
হয়ে যাবে। জীবনে আর কোন ক্লেদ কোথাও থাকবে না। নতুন অধ্যায় শুরু হবে জীবনে। একটি
Stroke-এ অতীতকে দুহাতে মুছে ফেলা যাবে।'
অতীতের সমস্ত ভুলভ্রান্তি
ঝেড়ে ফেলে ঋত্বিকের নতুন দিনের পথে যাত্রা করার যে চেষ্টা, সেটার এক এবং একমাত্র কারণ
যে সুরমা দেবী ছিলেন, এটা ঋত্বিকের ভাষ্যে যথেষ্ট স্পষ্ট―
'যা ধারণ করে থাকে তাই যদি ধর্ম হয়। তবে তুমি আমার ধর্ম। ভালবাসতে হলে চাই
Classical approach, নীরবে ভালবাসার সাধনা করা― সে করা কি কোনোদিন হয়ে উঠবে নিকট ভবিষ্যতে! 'নাগরিক'-এ
একটা Dialogue লিখেছিলাম। নায়ক নায়িকাকে বলছে 'ঝাঁ ঝাঁ রোদ্দুরে কালো দীঘিতে অবগাহন
করার মত শান্তি তোমার সান্নিধ্যে।' Scene টা এখন বই-এ নেই। যখন লিখেছিলাম কল্পনায় কি
তুমি ছিলে? - না; কারণ সে কল্পনা যে বাস্তবে এমন Literal truth হয়ে উঠবে, প্রতিটি পদক্ষেপে
সত্তাকে নাড়া দেবে, যে অনুভূতি জাগাবে, তা বুঝিনি সেদিন। Communist-দের Communism চাওয়ার
মত আর কি! কল্পনায় সত্যকে পেয়েছিলাম সেদিন। আজ বাস্তবে পাচ্ছি'।
অনেক স্বপ্ন নিয়ে
বিয়ের পর ঋত্বিক ফিল্মিস্তান স্টুডিওতে কাজ শুরু করেন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই ভেতরের
শিল্পীমন বিদ্রোহী হয়ে উঠতে থাকে। প্রথমত, তিনি কলকাতা ছাড়তে চান না। সাথে সাথে শুধু
পয়সার জন্য নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাজ করে যাওয়াটা অসহ্য হয়ে ওঠে একসময়। বোম্বে যাওয়ার
কিছুদিনের মধ্যেই তিনি লেখেন―'দেখো লক্ষ্মী, এ জীবন আমাদের নয়। পয়সার জন্য করে
যাওয়া, আগে করিনি। এখন করতে ঘেন্না হচ্ছে। ... অথচ নিজের মনের মত কাজ করে এক পয়সাও
না কামিয়ে আমি শান্তি পেয়েছি আগে। ... অন্ততঃ এই বছরটা আমি দেখবই। আর সুযোগ খুঁজব কি
করে কলকাতায় কিছু আয়ের পথ করা যায়। একবার করতে পারলে এখানে আর একদিনও থাকা নয়।'
বোম্বেতে ঋত্বিক ছিলেন
প্রায় দুই বছর। ফিরে এসে 'অযান্ত্রিক' এর কাজ শুরু করেন। রাঁচিতে শূটিং করার সময় অল্প
অল্প বিয়ার খাওয়া শুরু। একটু খেলে কিচ্ছু হবে না― এইভাবেই। এরপর নির্মাণ করেন 'বাড়ি থেকে পালিয়ে'।
দুইটি চলচ্চিত্রের একটিও ব্যবসায়িক সাফল্য পায়নি। হতাশা বাড়ে, সাথে বাড়ে মদ্যপানের
মাত্রা। এরপর একে এক তৈরি হয় 'মেঘে ঢাকা তারা' আর 'কোমল গান্ধার'। প্রথমটি কিছুটা সফল
হলেও দ্বিতীয়টি সুপার ফ্লপ হয়। শুরু হয় বাংলা মদ খেয়ে পড়ে থাকা। আরম্ভ করেন 'সুবর্ণরেখা'।
প্রডিউসার চলে যাওয়ায় সেটা আর মুক্তিলাভ করে না। মদের উপর বেঁচে থাকতে আরম্ভ করেন ঋত্বিক।
মাইহারের বাবা আলাউদ্দিন খাঁ-র উপর ডকুমেন্টরী, বিভূতিভূষণের 'আরণ্যক' কোনটির কাজই
আর করতে পারেন না। এরপর শুরু হয় অ্যালকোহলিক ইনস্যানিটি। এদিকে 'বগলার বঙ্গদর্শন' অসমাপ্ত
থেকে যায়। শুরু হয় চোলাই মদ, স্নানখাওয়া বন্ধ।
পুণে ফিল্ম ইনস্টিটিউট
থেকে এ সময়টাতে লেকচার দেবার জন্য ডাক আসত। পরে সেখানকার ভাইস-প্রিন্সিপাল হন। যে কলকাতা
ছাড়া থাকতে চাইতেন না সেটার উপরেও কিছুটা বীতশ্রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন―
'... তারপর আর আমার ছবি করার মোটে ইচ্ছে নেই, কলকাতাও আর ভাল লাগছে না। এখানে সন্মান,
বাঁধা মাইনে এবং মনের মত কাজ'।
পুণেতে আনন্দ পেয়েছিলেন
এটা পরে বলেছিলেন। নিজের ছন্নছাড়া স্বভাব জানা ছিল, মদ্যপান ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার
একটা চেষ্টাও ছিল এই সময়টাতে। তিনি লিখছেন― '...অজিতকে জিজ্ঞাসা কোর―
পথে বা এখানে এসে একেবারে ছেড়ে দিয়েছি। এই দুই-আড়াই মাস হোক আমার চেষ্টা। দেখি, আবার
সহজ জীবনে ফিরতে পারি কিনা। ... টুনু-বুলু-বাবুকে আপ্রাণ ভালবাসা। তোমাকে তো বটেই।
সব থেকে তোমাকে বঞ্চিত করলেও তুমি ছাড়া আমার কেউ নেই। সব ছেড়ে টাকা টাকা করে ঘুরে সেটাকেই
প্রকাশ করার বোধহয় চেষ্টা করি। জানি না ঠিক'।
একই ধরণের কথা পাওয়া
যায় আরেকটি চিঠিতে― '...এখানে আসার পর থেকে একদম খাচ্ছি না। এবং ইচ্ছে
আছে আর খাবও না। এভাবে আমাদের সবার জীবন নষ্ট হতে দেব না। একবার শেষ চেষ্টা করে দেখি।
আমার দৃঢ় বিশ্বাস, যা গেছে তাকে আর ফেরানো যাবে না, কিন্তু এখনও অনেক কিছু করার ক্ষমতা
আছে, তোমাদের আনন্দ দেবার আছে এবং সেগুলো আমি দেবই। ... অনেকবার বলেছি, এবারে কাজে
দেখাতে হবে'।
নিজের কৃতকর্মের জন্য
নিজের ভেতরেও অনুশোচনা ছিল― '... আসার সময় তোমার যা চেহারা দেখে এসেছি, প্রতি
মূহূর্তে আমার ভয় করছে। ভাল করে চিকিৎসা কর। আমি জানি, আমিই তোমার একমাত্র অসুখ, এবং
আমি ঠিক না হলে তোমার ভাল হবে না। এবং তুমি আমার ওপরে সম্পূর্ণ আস্থা হারিয়ে ফেলেছ'।
কিন্তু এত কিছুর পরেও
এই অস্বাভাবিকতা আর ঠিক হয়না। কোন কিছু একটা নিয়ে ঝগড়া করে চাকরি ছেড়ে দিয়ে চলে আসেন।
সম্ভবত সরকারী নিয়মকানুন শিল্পীমন মানতে পারেনি। বারবার অজ্ঞান হয়ে পড়তে শুরু করেন।
হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ডাক্তার দেখে বলেন ইনফ্যান্টাইল এবং ডবল পার্সোনালিটি। এর
মধ্যে 'Scientists of Tomorrow' নামের একটি ডকুমেন্টরী এবং 'রঙের গোলাম' নামে একটি
চলচ্চিত্রের কিছুটা শূটিং করেন। এরপর ঋত্বিককে ভর্তি করা হয় গোবরা মেন্টাল হসপিটালে।
এখান থেকে বেরিয়ে 'পুরুলিয়ার ছৌঁ' এবং 'আমার লেনিন' তৈরি করেন। 'আমার লেনিন' রিলিজ
হয়না, আবার মদ খাওয়া শুরু হয়।
ঋত্বিকের এই চলমান
অস্বাভাবিকতার পরিপ্রেক্ষিতে হতাশ হয়ে সুরমা ঘটক সাঁইথিয়ায় একটা গার্লস স্কুলে চাকরি
নিয়ে চলে যান। ছেলে-মেয়েদের কথা ভেবে এটা ছাড়া তাঁর আর কোন উপায় ছিল না। বারো বছরের
একটি অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটে।
এসবের মধ্যবর্তী সময়ে
ঋত্বিক লেখালেখি করেন বেশ কিছু। একটি প্রবন্ধে লিখছেন― 'আমার শিল্পীজীবনের সক্রিয় ও নিষ্ক্রিয় এই দুই অবস্থাতেই বুঝেছি যে,
সংগ্রামকে শিল্পীজীবনের নিত্যসঙ্গী করে তুলতে হয়। নানা প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে সংগ্রাম
করে যেতে হবে। সাময়িকভাবে কোনো সংকট আচ্ছন্ন করে ফেললেও সামগ্রিকভাবে তা যেন আপোসের
পথে টেনে নিয়ে না যায়, অর্থাৎ সংকটের কাছে আমরা যেন বিবেক-বুদ্ধি সবকিছু নিয়ে আত্মসমর্পন
না করি'। এখানে একটি জিনিস চিন্তা করার ব্যাপার আছে। এই কথাগুলো তিনি কি অবস্থায় লিখছেন?
বোতল খেয়ে চলেছেন ক্রমাগত, হাসপাতালে থাকছেন-ছাড়া পাচ্ছেন, আবার অসুস্থ্য হচ্ছেন, পরিবারের
ভবিষ্যৎ কি হবে তিনি কিছুই জানেন না, যত স্বপ্ন দেখেছেন, যত কিছু করবেন ভেবেছেন, কিছুই
হয়ত আর করা হয়ে উঠবে না। এমন নাজুক পরাজিতপ্রায় অবস্থাতেও তিনি লিখে চলেছেন শিল্পের
দায়বদ্ধতার কথা। শিল্প একটি দ্বায়িত্ব। শিল্প মানুষের কথা বলবে, জীবনের কথা বলবে, শিল্প
হবে সত্যের অবলম্বন, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী― এটাই শিল্পের
দায়বদ্ধতা। যে দায়বদ্ধতা থেকে ঋত্বিক
ঘটক বিচ্যুত হননি কখনও।
আরেকটি প্রবন্ধে লিখছেন―
'আমার ছবিগুলোতে আমি যতদূর পেরেছি চেষ্টা করেছি আমার দেশ ও আমার দেশের মানুষের দুঃখকষ্ট
ও নির্যাতনকে চিত্রিত করতে। আমার সাফল্য যতদূরই হোক না কেন, আমার আন্তরিকতার কোন অভাব
এতটুকুও ছিল না বলে মনে হয়'। ঋত্বিক মানুষকে রঙীন কোন অবাস্তব চমক তাঁর সিনেমার মাধ্যমে দেখাতে চাননি। নিজের চোখে
যেমনভাবে বাস্তবকে দেখেছেন, মানুষের জীবনপ্রবাহকে দেখেছেন, সেটাকেই তুলে এনেছেন সেলুলয়েডে।
ঋত্বিকের মূল সূত্রটি তাই―'সত্যম্, শিবম্, সুন্দরম্', যার অর্থ 'সত্য,
শাশ্বত, সুন্দর'। ঋত্বিক বলেন― 'জীবনকে উপলব্ধি করতে না পারলে শিল্পী হওয়া যায়
না এবং শিল্পী না হলে, আপনার কোনো অধিকার নেই মানুষকে প্রবঞ্চিত করার'।
এরপর বাংলাদেশে 'তিতাস
একটি নদীর নাম' সিনেমার কাজ শুরু হয়। প্রায় একই সাথে শুরু হয় 'যুক্তি তক্কো আর গপ্পো'।
একইসাথে বাংলাদেশ ও কলকাতায় দুইটি সিনেমার কাজের পরিশ্রমে আর মদ্যপানের ফলে শরীর অসুস্থ্য
হতে থাকে। 'তিতাস একটি নদীর নাম' ঋত্বিকের জীবনকালে কলকাতায় যায়নি, সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান
সম্পর্কিত নানান সরকারী জটিলতার কারণে। এরপর সমাপ্ত হয় জীবনের শেষ চলচ্চিত্র 'যুক্তি
তক্কো আর গপ্পো'। সেটাও মুক্তি পায়নি ঋত্বিকের জীবদ্দশায়।
'যুক্তি তক্কো আর গপ্পো' ঋত্বিকের আত্মজৈবনিক চলচ্চিত্র। একজন মাতাল বুদ্ধিজীবী নীলকণ্ঠ বাগচীর গল্প। যে তাঁর বন্ধুদের মত সস্তা জনপ্রিয়তার লোভে নিজেকে বিক্রি করে দেয়নি। নীলকণ্ঠের স্ত্রীও তাঁকে ছেড়ে চলে যায়। কিন্তু শত বাঁধা বিপত্তি সত্ত্বেও শিল্পের দায়বদ্ধতা থেকে বিচ্যুত হয়না নীলকণ্ঠ। শেষ দৃশ্যে গুলি লেগে মারা যায় সে। ঋত্বিক বলতেন― 'আমি মারা যাব। মাইকেল মধুসূদন, প্রমথেশ বড়ুয়া, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় যেভাবে মারা গেছেন, সেই ভাবেই মারা যাব'। তাই হয়ত নীলকণ্ঠের মৃত্যুদৃশ্যের এক দার্শনিক চিত্রায়ণ করেন ঋত্বিক। মৃত্যুর আগে নীলকণ্ঠ তাঁর স্ত্রীকে বলে যায়― 'মানিকবাবুর সেই মদনতাঁতীর কথা মনে আছে তোমার? সেই যে বলেছিল, ভূবন মহাজনের টাকার সুতো কিনে তাঁত চালাবো? তোদের সঙ্গে বেইমানী করবো? তাঁত না চালিয়ে পায়ের গাঁটে বাত ধরে গেছে তাই খালি তাঁত চালালুম একটু। কিছু একটা করতে হবে তো? কিছু একটা করতে হবে তো?'
নাহ! বাস্তব জীবনেও
ভূবন মহাজনদের পাত্তা দেননি শিল্পী ঋত্বিক ঘটক। মাথা উঁচু করেই বিদায় নিয়েছেন এই অক্লান্ত
যোদ্ধা, সেলুলয়েডের বিশ্বস্ত এই মদন তাঁতী।।
অরিন্দম গুস্তাভো
বিশ্বাস
১৩ ―
১৭ জুলাই ২০১৩
ঢাকা
ঋণস্বীকারঃ ঋত্বিক
― সুরমা ঘটক, অনুষ্টুপ।
ক্যামেলিয়া'র চিঠি
প্রথম বর্ষ প্রথম সংখ্যা, নভেম্বর ২০১৩ তে প্রকাশিত