পৃষ্ঠাসমূহ

১৯ জুল, ২০১৩

আমারে তুমি অশেষ করেছ

‘আমি ঘরে ফিরে এলাম। গ্লাস ভর্তি পেপসি, সাথে কিছু বরফও ভাসছে। দুধকে পেপসি বানানোর মন্ত্র তাহলে সত্যি আছে? আমি দৌড়ে বাইরে বের হলাম। দারোয়ান শুধু বলতে পারল একটা ছেলেকে সে শিষ দিতে দিতে রাস্তা দিয়ে চলে যেতে দেখেছে…’

এই লাইনগুলি কতদিন আগে পড়া? বারো বছরের বেশী তো হবেই। কিন্তু মনে হয় যেন এই সেদিন পড়েছি। আমার মস্তিস্ক এতদিন ধরে এই লাইনগুলি সযত্নে সংরক্ষণ করে চলেছে। কিন্তু কেন? এই লাইনগুলি আমাকে আমার ছেলেবেলায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারে এই কি তার কারণ? এই লাইনগুলা তো শুধু গল্পের লাইন নয়, এর সাথে জড়িয়ে আছে ছোটবেলার ফেলে আসা মফস্বল, বাড়ির ছাদ, স্কুল, আম্মুর হাতের মার, পেছনের পুকুরে পড়ে যাওয়া টেনিস বল…আরও কত কি! আর হ্যাঁ, এবং অবশ্যই একটি ধূসর মলাটের গল্পের বই। বইটির নাম – ‘মজার ভূত’। লেখক – ‘হুমায়ূন আহমেদ’। আমাদের অতিপ্রিয় হুমায়ূন স্যার। যিনি ভূতের মত ভয়ঙ্কর একটা জিনিসের মধ্যেও মজা ছড়িয়ে দিয়ে আমার ছেলেবেলাকে কল্পনার রঙে রঙিন করে তুলেছিলেন।

একটা মেয়ে বসে আছে, চুলগুলো উড়ছে, বেশ বড় একটা ফাঁকা জায়গা। বাবা বলেন, ‘এইটা তেঁজগাও এয়ারপোর্ট’। আমি সোজা হয়ে বসি, শুরু হচ্ছে ‘বাকের ভাইয়ের নাটক’, এখন বাকের ভাইকে দেখাবে। দাঁড়িওয়ালা লোকটিকে বড় ভাল লাগে আমার। দড়ি জাতীয় কিছু হাতে পেলেই নিজেকে বাকের ভাই বলে মনে হয়। ‘হাওয়ামে উড়তা যায়ে, হাওয়ামে উড়তা যায়ে’ এমন সুর তুলতে তুলতে আমি দড়িটিকে আঙ্গুলে ধরে নিয়ে একবার ডানে একবার বামে ঘুরাতে থাকি। দিন কেটে যায়। হঠাৎ শুনি বাকের ভাইয়ের নাকি ফাঁসি হয়ে যাবে। এ আবার কেমন কথা? আমার শিশুমন মানতে চায় না। বড়রা সবাই দেখি এটা নিয়ে আলোচনা করে। মন খারাপ করে টিভির সামনে বসি। অনেক লোকজন, এর মাঝে বাকের ভাইকে দড়ি দিয়ে বেঁধে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, বোঝা গেল যে তার ফাঁসি হয়ে গেল। মনে হল যেন জীবন থেকে একটা আনন্দ হারিয়ে গেল।

এবার আমি কিছুটা বড় হয়েছি। শোনা গেল আবার হুমায়ূন আহমদের নাটক হবে টিভিতে। এই নাটকের নাম ‘আজ রবিবার’। মোটা চশমা পরা একটা লম্বু ছেলে প্রতিবার সিঁড়ির এক জায়গাতে হোঁচট খায়। এর ব্যাপারটা বুঝে ওঠার পর তাকে সিঁড়ির দিয়ে উঠতে দেখলেই আমি বাবা-মা’কে চমকে দিয়ে চীৎকার দিয়ে উঠি – ‘এইবার পড়ে যাবে, পড়, পড়, হা হা হা’। ন্যাকা গলায় সেই ‘তিতলী ভাইয়া কঙ্কা ভাইয়া’ ডাক এখনও যেন কান পাতলে আমি শুনতে পাই।

আমার ছোটবেলার হাউজ টিউটর জন প্রভুদানের কল্যাণে দেশী বিদেশী শিশুসাহিত্য আমি প্রচুর পড়েছি। আমার আম্মুর অভিযোগ এইজন্যই নাকি স্কুলের বই পড়ার ব্যাপারে আমার কোন আগ্রহ নেই, আমি নাকি শুধু গল্পের বই পড়তে চাই। তখন বয়ঃসন্ধিকাল চলছে। কোন কিছুই তেমন ভাল লাগে না, বাবা-মা’র কথাও শুনতে ইচ্ছা করে না। নিজের মত থাকতে মন চায়। নতুন বাসার বুক শেলফে অনেক বই সাজানো ছিল। সেইখানে আমি কিভাবে যেন ‘পারাপার’ নামের একটা বই আবিষ্কার করলাম। এটা যে কিভাবে আমাদের বাড়িতে এসেছিল সেটা আমি আজও জানি না। যেহেতু হুমায়ূন আহমেদের বই, ভাবলাম পড়ে দেখা যাক। পড়লাম এবং পড়ে পাগল হয়ে গেলাম। হিমু নামের একটা ছেলে, এ তো আমার স্বপ্নের চরিত্র, আমি তো এমনই হতে চাই। শেষ লাইনটা ছিল- ‘আমার মনে হল পৃথিবীর সব নারীই রূপা আর সব পুরুষই হিমু’। অসাধারণ। এরপর আর কোন কথা নেই, বাছাবাছির বালাই নেই, মলাটে হুমায়ূন আহমেদ লেখা থাকলেই গ্রোগাসে গিলতে থাকি। পরে দেখা গেল যে এই হিমু ছেলেটাকে নিয়েই আরও গল্প আছে। অনেক মান-অভিমান করে আম্মুকে রাজী করিয়ে একটা পকেটবিহীন হলুদ পাঞ্জাবী বানিয়ে নিলাম। এই হলুদ পাঞ্জাবী গায়ে চড়িয়ে আমি দুপুর রোদের মধ্যে হেঁটে বেড়াই, কেমন যেন উদাস উদাস লাগে, নিজেকে হিমু বলে মনে হয়। এরপর আস্তে আস্তে মিসির আলী, শুভ্র এদের সাথেও আমার বেশ ভাল জানা পরিচয় হয়ে গেল।

হুমায়ূন স্যারের সাথে আমার একবারই দেখা হয়েছে। ২০০৪ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি, আমার প্রথম একুশে বইমেলাতে। যতদূর মনে পড়ে সেদিন বৃহস্পতিবার, তাই বইমেলাতে বহু নামকরা ব্যাক্তিদের আনাগোনা। আমি একটা নীল রঙের ডায়েরী নিয়ে অটোগ্রাফ শিকার করে বেড়াচ্ছি। অন্যপ্রকাশের সামনে বিশাল ভিড় আর ঠেলাঠেলি। অনেকভাবে দেখেশুনে নিশ্চিত হলাম যে, স্যার অটোগ্রাফ দিচ্ছেন। বহুকষ্টে লাইনের শেষ খুঁজে পেয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে গেলাম। বহু প্রতীক্ষা শেষে লাইনের সামনে পৌঁছে স্যারকে সামনাসামনি দেখে কেমন জানি ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলাম। স্যার জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কি নাম?’। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মত আমার নাম বললাম। স্যার খসখস করে কিছু লিখলেন, আমি ডায়েরীটা ফেরত নিলাম। ভিড় ঠেলে বাইরে এসে মনে হল বিশ্বজয় করে এসেছি। ঘুরিফিরি আর বারবার ডায়েরীর পাতা উল্টিয়ে স্যারের অটোগ্রাফটা দেখি। সে এক বড়ই আশ্চর্য অনুভূতি।

এরপর অনেক বছর কেটে গেছে, সাম্প্রতিককালে স্যারের লেখা পড়ার সেই প্রচন্ড আগ্রহটা হয়ত ছিল না, কিন্তু এটা খুবই সত্যি যে আমার ছেলেবেলা থেকে কিশোর-যৌবনকালকে তিনি তার লেখনী দিয়ে উপভোগ্য করে তুলেছিলেন। তার লেখা পড়ে একধরণের তৃপ্তির ঘোর নিয়ে বড় হয়েছি। বারবার তাঁর বিভিন্ন লেখায় আমি নিজেকে খুঁজে পেয়েছি, নিজের জীবনের স্বপ্নকে দেখতে পেয়েছি তাঁর লেখা বইয়ের পাতায়।

স্যারের কোন একটা বইয়ের শুরুতে স্যার রবীন্দ্রনাথের এই লাইনগুলো লিখেছিলেন। স্যারের সাথে আরেকবার দেখা হলে হয়ত আমি তাঁকে এই কথাটাই বলতে চাইতামঃ

আমারে তুমি অশেষ করেছ
   এমনি লীলা তব।
ফুরায়ে ফেলে আবার ভরেছ
   জীবন নব নব।

স্যারের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা।।


অরিন্দম গুস্তাভো বিশ্বাস
২৯ আগষ্ট ২০১২
ঢাকা