The people who are crazy
enough to think they can change the world are the ones who do.
— Apple's 'Think
Different' commercial, 1997
পৃথিবীকে পরিবর্তন করে দেবে এমন উদ্ভট চিন্তা করা উন্মাদেরাই শুধুমাত্র সেটা করতে পারে।
স্টিভ জবসে্র এই বক্তৃতাটি অনুবাদ করার ইচ্ছে আমার অনেকদিনের। এটা আমার এতই প্রিয় যে এতক্ষণে অরিন্দম-এর জন্য মটো হিসেবে বেছে নিয়েছিলাম 'ক্ষুধার্ত থেকো, বোকা থেকো' এই লাইনটিকে। তাই তখন থেকেই নিজের মনের ভেতর একটা দায়বদ্ধতা ছিল এটা অনুবাদ করার। বক্তৃতাটি আমি প্রথম পড়েছিলাম প্রথম আলো-তে, সম্ভবত ২০১০ সালের শুরুর দিকে। 'স্বপ্ন নিয়ে' পাতাটি তখন নতুন নতুন শুরু হয়েছে, সেখানেই ছাপা হয়েছিল এটার একটি সংক্ষিপ্ত অনুবাদ। সেটা পড়ে দারুণ এক মুগ্ধতায় আচ্ছন্ন হয়েছিলাম। তারপর পুরো ইংরেজীটা পড়ে এবং সাথে সাথে ভিডিওটি দেখে সেই মুগ্ধতা বেড়ে গিয়েছিল আরও কয়েকগুণ। আজও সেই অপার মুগ্ধতা অটুট আছে।
স্টিভেন পল জবস্(১৯৫৫ - ২০১১) ছিলেন এ্যাপেল কম্পিউটার এবং পিক্সার এ্যানিমেশন স্টুডিওর সি.ই.ও.। ২০০৫ সালের ১২ই জুন স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির সমাবর্তন অনুষ্ঠানে তিনি এই বক্তৃতাটি দিয়েছিলেন। বিভিন্ন ব্লগে/ফেসবুকে এই বক্তৃতাটির সম্পূর্ণ অনুবাদ পাওয়া যায় এটা আমি জানি। পুরোটা পড়ে না দেখলেও সেটা/সেগুলো আমার চোখে পড়েছে। আমার এই অনুবাদটির বিষয়ে একটি ছোট্ট কথা বলে নেওয়া প্রয়োজন। স্ট্যানফোর্ডের ওয়েবে এই বক্তৃতার যে ভার্সনটি পাওয়া যায় সেটা হচ্ছে 'প্রিপেয়ার্ড টেক্সট'। আমি মূল ভিডিও দেখে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন-পরিবর্ধন করে 'ডেলিভার্ড টেক্সট' তৈরি করে নিয়েছি। তাই এই অনুবাদটি হচ্ছে 'ডেলিভার্ড টেক্সট' এর অনুবাদ।।
বিশ্বের অন্যতম সেরা একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আজ তোমাদের এই সমাবর্তনের দিনে এখানে উপস্থিত থাকতে পেরে আমি সন্মানিত বোধ করছি। সত্যি কথা হল যে আমি কোনদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরোতে পারিনি, আর এটাই আমার সবচেয়ে কাছে থেকে দেখা কোন সমাবর্তন অনুষ্ঠান। আজ আমার জীবনের তিনটি গল্প আমি তোমাদের বলতে চাই। আর এই দিনে কেবল ওইটুকুই, কোন গুরুগম্ভীর আলোচনা নয়— শুধুই তিনটি গল্প।
প্রথম গল্পটি কিছু বিচ্ছিন্ন বিন্দুকে অভিন্ন সরলরেখায় সংযুক্ত করা নিয়ে।
আমি রিড কলেজের পড়াশুনার ইতি টেনেছিলাম প্রথম ছয় মাস পরেই, কিন্তু তারপরও একজন অনিয়মিত ছাত্র হিসেবে সেখানে থেকে গিয়েছিলাম আরও প্রায় আঠারো মাস। প্রশ্ন হল, আমি কেন পড়াশুনা ছেড়ে দিয়েছিলাম?
এই ঘটনার শুরু হয়েছিল আমার জন্মেরও আগে। আমার জন্মদাত্রী মা ছিলেন একজন অবিবাহিত গ্রাজুয়েট ছাত্রী এবং তিনি আমাকে দত্তক দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি দৃঢ়ভাবে চেয়েছিলেন যে আমার দত্তক পিতা-মাতাকে অবশ্যই কলেজ গ্রাজুয়েট হতে হবে। তাই আমার জন্মের পর একজন আইনজীবি এবং তাঁর স্ত্রী আমাকে দত্তক নেবেন তেমনভাবেই সবকিছু ঠিকঠাক ছিল। কিন্তু যখন আমার জন্ম হল তখন শেষ মুহূর্তে গিয়ে তাঁরা সিদ্ধান্ত নিলেন যে তাঁরা আসলে একটি মেয়ে শিশুকে চেয়েছিলেন। তাই আমার ওয়েটিং-লিস্ট এ থাকা বাবা-মা মাঝরাত্তিরে একটি ফোনকল পেলেনঃ 'আমরা একটি অপ্রত্যাশিত ছেলে শিশুকে পেয়েছি; তোমরা কি তাকে চাও?' তাঁরা উত্তর দিলেনঃ 'হ্যাঁ, অবশ্যই চাই'। আমার জন্মদাত্রী মা পরবর্তীতে জানতে পারেন যে আমার মা কলেজ গ্রাজুয়েট নন এবং আমার বাবা কোনদিন হাইস্কুলই পাশ করেননি। তাই তিনি দত্তক দেবার চূড়ান্ত আইনি কাগজপত্রে স্বাক্ষর দিতে আপত্তি করেন। কিন্তু কয়েকমাস পরে তিনি রাজী হন যখন আমার বাবা-মা প্রতিজ্ঞা করেন যে আমাকে একদিন তাঁরা কলেজে পড়াবেন। এভাবেই আমার জীবন শুরু হয়েছিল।
সতেরো বছর পর, আমি ঠিকই একদিন কলেজে গেলাম। কিন্তু বোকামি করে আমি এমন একটি কলেজ পছন্দ করলাম যেটা ছিল প্রায় স্ট্যানফোর্ডের মতই খরুচে, আর আমার চাকুরীজীবি বাবা-মা'র জমানো সমস্ত টাকা-পয়সা আমার কলেজের ফি পরিশোধেই শেষ হয়ে যাচ্ছিল। মাস ছয়েক পর, আমি এসবের কোন মানেই খুঁজে পেলাম না। আমার কোন ধারণাই ছিল না যে আমি জীবনে কী করতে চাই বা আমার কলেজ কিভাবে আমাকে সে ব্যপারে সাহায্য করবে। কিন্তু এদিকে আমি আমার বাবা-মা'র গোটা জীবনের কষ্টার্জিত সঞ্চয় খরচ করে ফেলছিলাম। তাই আমি পড়াশুনা ছেড়ে দেবার সিদ্ধান্ত নিলাম এবং বিশ্বাস করতে চাইলাম যে সবকিছুই একদিন ঠিকঠাক হয়ে যাবে। তখন আমি এটা নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন ছিলাম, কিন্তু পেছনে ফিরে তাকালে আমি দেখি যে সেটা ছিল আমার জীবনের সেরা সিদ্ধান্তগুলোর একটি। পড়াশুনা ছাড়ার সাথে সাথে আমি বিরক্তিকর নিয়মিত ক্লাসগুলো থেকে ছাড়া পেলাম এবং অন্য এমন সব ক্লাসে যোগ দিতে শুরু করলাম যেগুলো আমাকে অনেক বেশী আকর্ষণ করত।
এ সময়টা আমার জন্য মোটেও সহজ ছিল না। ছাত্রাবাসে আমার জন্য কোন সিট বরাদ্ধ না থাকায় আমি বন্ধুদের ঘরের মেঝেতে ঘুমাতাম, প্রতিটি বোতল পাঁচ সেন্ট দরে পুরনো কোকের বোতল ফেরত দিয়ে আমি খাবার কেনার পয়সা জোগাড় করতাম, আর প্রতি রবিবার রাতে সাত মাইল পায়ে হেঁটে হরে-কৃষ্ণ মন্দিরে চলে যেতাম সপ্তাহে একদিন একটু ভাল-মন্দ খাওয়ার জন্য। এটা আমার দারুণ পছন্দ ছিল। আমার কৌতুহল আর মনের ইচ্ছা অনুসরণ করে আমি যেসব জিনিসের প্রতি আকৃষ্ট হতাম, একসময় তার বেশীরভাগই অমূল্য হয়ে উঠেছিল। এই প্রসঙ্গে একটি উদাহরণ দিচ্ছিঃ
সেই সময়ে রিড কলেজে সম্ভবত দেশের সেরা ক্যালিগ্রাফি প্রশিক্ষণ দেওয়া হত। সারা ক্যাম্পাস জুড়ে প্রতিটি পোস্টার, প্রতিটি ড্রয়ারের লেবেল ইত্যাদি সবকিছু চমৎকার হস্তাক্ষরে ক্যালিগ্রাফি করা ছিল। যেহেতু আমি আর নিয়মিত ছাত্র ছিলাম না এবং নির্দিষ্ট কোন ক্লাসে যোগদানের বাধ্যবাধকতা আমার নেই, তাই আমি ক্যালিগ্রাফি শেখার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমি শেরিফ এবং স্যান্স শেরিফ টাইপফেস সম্বন্ধে শিখলাম, বিভিন্ন অক্ষর বিন্যাসের মধ্যে পরিবর্তনশীল স্পেসের বিষয়ে জানলাম, আরও শিখলাম সেই জিনিসগুলো যা অসাধারণ টাইপোগ্রাফিকে অসামান্য করে তোলে। এটা ছিল অত্যন্ত সুন্দর, ঐতিহাসিক, এমন সব সূক্ষ্ণ শৈল্পিকতায় পরিপূর্ণ যেটা বিজ্ঞানের আয়ত্বের মধ্যে নয়, এবং আমি এসবে দারুণভাবে মুগ্ধ হলাম।
তবে এসবের বাস্তব প্রয়োগ ঘটানোর নূন্যতম কোন সম্ভাবনাও আমার জীবনে ছিল না। কিন্তু দশ বছর পর যখন আমরা ম্যাকিনটশ কম্পিউটার ডিজাইন করছিলাম, তখন আমার এগুলো দরকার পড়ল। আর আমরা এর পুরোটুকুই ম্যাক এর মধ্যে ডিজাইন করে দিলাম। সেটিই ছিল সুন্দর টাইপোগ্রাফি সমৃদ্ধ প্রথম কম্পিউটার। আমি যদি কলেজে সেই ক্যালিগ্রাফির কোর্সটি না করতাম, তাহলে ম্যাক-এর এতগুলো টাইপফেস অথবা আনুপাতিক স্পেসযুক্ত ফন্ট— কোন কিছুই থাকত না। আর উইন্ডোজ যেহেতু ম্যাক-এর সরাসরি নকল করেছে তাই বলা যায় যে কোন পার্সোনাল কম্পিউটারেই এটা থাকত না। আমি যদি পড়াশুনা না ছাড়তাম তাহলে আমি কোনদিনই সেই ক্যালিগ্রাফি কোর্সটা করতে যেতাম না, আর পার্সোনাল কম্পিউটারেও হয়ত এমন মনোমুগ্ধকর টাইপোগ্রাফি দেখতে পাওয়া যেত না। অবশ্য আমার কলেজ জীবনে থেকে এই বিন্দুগুলো যুক্ত করা অসম্ভব ছিল। কিন্তু দশ বছর পর পেছনে ফিরে দেখলে এটা অত্যন্ত সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে।
এই বিন্দুগুলো কখনও সামনের দিকে তাকিয়ে যুক্ত করা যায় না; শুধুমাত্র পেছনের দিকে ফিরেই এটা করা সম্ভব। তাই তোমাকে আস্থা রাখতে হবে যে এই বিচ্ছিন্ন বিন্দুগুলো তোমার ভবিষ্যত জীবনে একদিন সংযুক্ত হয়ে যাবে। কোন একটা কিছুর উপর তোমাকে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে—
তোমার সাহস, নিয়তি, জীবন, কর্মফল অথবা সেটা অন্য যাই হোক না কেন। কারণ এই বিন্দুগুলো তোমার ভবিষ্যৎ জীবনে একদিন সংযুক্ত হবে— এই বিশ্বাসই তোমাকে সাহস যোগাবে তোমার হৃদয়ের বোধকে অনুসরণ করার, এমনকি গতানুগতিক পথ থেকে তোমাকে দূরে সরে যেতে হলেও। আর সেটাই তোমার জীবনে সমস্ত পার্থক্য গড়ে দেবে।
আমার দ্বিতীয় গল্পটির বিষয় প্রেম এবং পরাজয়।
আমার ভাগ্য ভাল ছিল—
কারণ আমি কী ভালবাসি সেটা আমি খুব অল্প বয়সে খুঁজে পেয়েছিলাম। ওজ এবং আমি যখন আমার বাবা-মা'র গ্যারেজে এ্যাপেল কম্পিউটার শুরু করি, আমার বয়স তখন কুড়ি। আমরা অত্যন্ত কঠোর পরিশ্রম করতাম, আর দশ বছরে গ্যারেজের মধ্যে আমাদের দুইজনের কোম্পানি থেকে এ্যাপেল হয়ে উঠল দুই বিলিয়ন ডলারের এক বিরাট কোম্পানি যার কর্মচারী সংখ্যা প্রায় চার হাজার। মাত্র একবছর আগে আমরা আমাদের সেরা কম্পিউটার ম্যাকিনটশ বাজারে ছেড়েছি এবং আমার বয়স সদ্যই
ত্রিশ বছর পূর্ণ হয়েছে। আর এমন সময় আমি বরখাস্ত হলাম। নিজের তৈরী করা কোম্পানি থেকে কেউ কিভাবে বরখাস্ত হতে পারে? আসলে এ্যাপেল যখন বড় হয়ে উঠছিল তখন আমরা এমন একজনকে আমাদের সাথে কাজ করার জন্য এনেছিলাম যাকে আমি আমার সাথে কোম্পানি চালানোর জন্য যথেষ্ট যোগ্য বলে ভেবেছিলাম, এবং বছরখানেক সবকিছু ঠিকঠাকই ছিল। কিন্তু তারপর আমাদের দু'জনের ভবিষ্যত ভাবনা আলাদা হতে শুরু করল এবং একটাসময় আমাদের মতপার্থক্য দেখা দিল। এমন অবস্থায়, আমাদের বোর্ডের ডিরেক্টরেরা তাঁর কথায় সমর্থন দিলেন। তাই ত্রিশ বছর বয়সে বেশ প্রকাশ্যেই আমাকে বের করে দেওয়া হল। আমার সাবালক জীবনের সমস্ত ধ্যানজ্ঞান শেষ হয়ে গিয়েছিল—
আর এটা ছিল দারুণ বেদনার।
আমার জানা ছিল না যে আমি এখন কী করব, আর এভাবেই কয়েকমাস চলে গেল। আমার মনে হয়েছিল যে আমি আমার পূর্বতন প্রজন্মের উদ্যোক্তাদের গৌরব ধরে রাখতে পারিনি, সেই ব্যটন যখন আমার হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছিল তখন আমি সেটা ফেলে দিয়েছি। আমি ডেভিড প্যাকার্ড এবং বব নয়েসের সাথে দেখা করে আমার এমন ভয়াবহ ব্যর্থতার জন্য ক্ষমা চাওয়ার চেষ্টা করলাম। আমার ব্যর্থতার গল্প মানুষের কাছে এতই প্রকাশিত ছিল যে আমি সিলিকন ভ্যালি থেকে পালিয়ে যাবার কথাও চিন্তা করলাম। কিন্তু ধীরে ধীরে আমার ভেতর আশার আলো ফুটতে শুরু করল— আমার কাজকে আমি তখনও ভালবাসতাম। এ্যাপেলের এইসব দূর্ঘটনা সেই ভালবাসাকে একচুলও টলাতে পারেনি। আমি প্রত্যাখ্যাত হয়েছিলাম ঠিকই, কিন্তু আমার প্রেম তখনও অটুট ছিল। তাই আমি পুনরায় শূন্য থেকে শুরু করার সিদ্ধান্ত নিলাম।
তখন আমি এটা বুঝতে পারিনি, কিন্তু একসময় দেখা গেল যে এ্যাপেল থেকে বরখাস্ত হওয়ার চেয়ে ভাল কোন ঘটনা আমার জীবনে ঘটতেই পারত না। সফল হওয়ার সেই দুঃসহ ভার চলে গিয়ে আমার উপর ভর করেছিল অনিশ্চিতের দিকে নতুন যাত্রা শুরু করার এক হালকা আমেজ। এটা আমাকে মুক্ত করে নিয়ে গিয়েছিল আমার জীবনের অন্যতম একটি সৃষ্টিশীল পর্যায়ে।
পরবর্তী পাঁচ বছরে, আমি নেক্সট নামে একটি কোম্পানি চালু করলাম, আরেকটি কোম্পানি বানালাম যার নাম পিক্সার, একই সঙ্গে অসাধারণ এক নারীর প্রেমে পড়লাম যার সাথে পরবর্তীতে আমি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হলাম। পিক্সার বিশ্বের প্রথম এ্যানিমেশন সিনেমা 'টয় স্টোরি' তৈরী করল এবং এখন সেটা বিশ্বের সফলতম এ্যানিমেশন স্টুডিও। নানান ঘটনাপ্রবাহে এ্যাপেল নেক্সট-কে কিনে নিল আর আমি এ্যাপেলে ফিরে এলাম, এবং নেক্সট-এ যে প্রযুক্তি আমরা তৈরী করেছিলাম সেটাই এ্যাপেলের নতুন যুগের সূচনা করল। আমি এবং লরেন দু'জনে এক সুখী পারিবারিক জীবন যাপন করতে লাগলাম।
আমি মোটামুটি নিশ্চিত যে এ্যাপেল থেকে আমাকে বের করে না দিলে এসবের কিছুই হত না। ওষুধ খেতে তেতো হতে পারে, কিন্তু রোগীর জন্য সেটার প্রয়োজন আছে। অনেকসময় জীবন একটি পাথর দিয়ে তোমার মাথায় আঘাত করবে, কিন্তু আশা হারিও না। আমি বিশ্বাস করি যে, একমাত্র আমার কাজের প্রতি ভালোবাসাই আমাকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছিল। তুমি কী করতে ভালোবাস সেটা তোমাকে খুঁজে বের করতে হবে। এই কথাটি ভালোবাসার মানুষের বেলায় যেমন সত্য, কাজের বেলাতেও ঠিক তেমনই। তোমার কাজ তোমার জীবনের একটা বড় অংশ জুড়ে থাকবে, এবং সেটাতে সন্তুষ্টি লাভের একমাত্র উপায় হচ্ছে এমন কোন কাজে নিজেকে নিয়োজিত করা যেটাকে তুমি একটি মহৎ কাজ বলে মনে কর। আর মহৎ কোন কাজ করার একমাত্র উপায়ই হচ্ছে নিজের সেই কাজকে ভালবাসা। তুমি যদি এখনও সেটাকে খুঁজে না পাও, তবে আরও খুঁজতে থাকো, এখনই কোন সিদ্ধান্ত নিও না। যেদিন তুমি তা খুঁজে পাবে সেদিন তোমার মনই তোমাকে সেটা জানিয়ে দেবে। আর প্রত্যেকটি ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের মতই, এটাও দিনে দিনে আরও মধুরতর হয়ে ওঠে। তাই খুঁজতে থাকো, এখনই শুরু কোরো না।
আমার তৃতীয় গল্পটি মৃত্যু সম্পর্কিত।
আমার বয়স যখন সতেরো বছর, তখন আমি এমন একটি উক্তি পড়েছিলামঃ 'তুমি যদি জীবনের শেষ দিন ভেবে নিয়ে প্রতিটি দিন যাপন কর, তাহলে একদিন নিশ্চিতভাবেই তোমার ধারণা সঠিক হবে।' এটা আমার ভেতরে একটা গভীর প্রভাব রেখে গিয়েছিল। আর সেইদিন থেকে গত তেত্রিশ বছর ধরে প্রতিদিন সকালে আমি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে প্রশ্ন করেছিঃ 'আজ যদি আমার জীবনের শেষ দিন হত, তাহলে কি আমি এটাই করতে যেতাম যা আমি আজ করতে যাচ্ছি?' এবং যখনই একনাগাড়ে কয়েকদিন এই প্রশ্নের উত্তর না-বোধক হত, আমি বুঝে যেতাম যে আমার কিছু একটা পরিবর্তন করতে হবে।
আমি শীঘ্রই মারা যাব এই কথাটি মনে রাখাই আমাকে আমার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো নিতে সাহায্য করেছে। কারণ প্রায় সবকিছুই— বাহ্যিক যত চাওয়া-পাওয়া, যত অহংকার, লজ্জিত আর ব্যর্থ হওয়ার যত ভয়— এগুলো সবই মৃত্যুর সামনে দাঁড়ালে দূর হয়ে যায়, শুধুমাত্র তাই থেকে যায় যা সত্যিকারের প্রয়োজনীয়। তোমার কিছু হারানোর আছে এই জাগতিক চিন্তার ফাঁদ অতিক্রম করার জন্য আমার মতে এটা মনে রাখাই সর্বশ্রেষ্ঠ পন্থা যে তুমি একদিন মারা যাবে। তুমি এমনিতেই সুরক্ষিত নও, তাই তোমার হৃদয়ের পথকে অনুসরণ না করার কোনই কারণ নেই।
প্রায় এক বছর আগে আমার ক্যান্সার ধরা পড়ল। সকাল সাড়ে সাতটার দিকে আমার একটি স্ক্যান করা হল এবং তাতে পরিষ্কারভাবে দেখা গেল যে আমার প্যানক্রিয়াসে একটি টিউমার রয়েছে। প্যানক্রিয়াস জিনিসটা যে কী সেটাই আমার জানা ছিলনা! ডাক্তাররা আমাকে বললেন যে এটা প্রায় দূরারোগ্য একপ্রকার ক্যান্সার এবং তিন থেকে ছয় মাসের বেশী আমার বেঁচে থাকার কোন সম্ভাবনা নেই। তিনি আমাকে বাড়ী ফিরে গিয়ে সবকিছু গুছিয়ে নিতে বললেন, ডাক্তারি ভাষায় যার অর্থ মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা। এর মানে তোমার ছেলেমেয়েদের কয়েক মাসের মধ্যেই সেই সমস্ত কিছু বলে যাওয়া, যেটা তুমি আগামী দশ বছর ধরে বলবে বলে ভেবে রেখেছিলে। এর অর্থ সবকিছু যথাযথভাবে বন্দোবস্ত করে রাখা, যেন এটা তোমার পরিবারের জন্য যথাসম্ভব সহজতর হয়। এর মানে সবাইকে শেষবারের মত বিদায় জানানো।
এমন চিন্তা
নিয়েই পুরোটাদিন কাটল। সন্ধ্যার পর আমার বায়োপসি করা হল। যেখানে একটি এন্ডোসকোপকে আমার গলা দিয়ে নামিয়ে দেওয়া হল, পাকস্থলি হয়ে সেটা পৌঁছে গেল অন্ত্রের ভেতর, একটি সুঁই দিয়ে আমার প্যানক্রিয়াস থেকে সংগ্রহ করে নিয়ে এলো টিউমারটির কিছু কোষ। আমি সংজ্ঞাহীন ছিলাম কিন্তু সেখানে উপস্থিত আমার স্ত্রী আমাকে বলেছিল যে ডাক্তাররা যখন সেই কোষগুলো মাইক্রোসকোপের নীচে রেখে পরীক্ষা করলেন তখন তাদের চোখ ভিজে উঠল, কারণ দেখা গেল এটি একটি বিরল প্রজাতির প্যানক্রিয়াটিক ক্যান্সার যেটা সার্জারীর মাধ্যমে সারিয়ে তোলা সম্ভব। আমি সেই সার্জারী করিয়েছি এবং এখন আমি সুস্থ্য।
জীবনকালে এটাই মৃত্যুর সবচেয়ে কাছাকাছি আমি গিয়েছি, এবং আশা করি আগামী কয়েকদশকের মধ্যে এটাই হবে সবচেয়ে নিকটতর। সেখান থেকে বেঁচে ফিরে এসে আমি এখন এটা আরও জোর দিয়ে বলতে পারি যে, মৃত্যু দরকারি হলেও সেটা সম্পূর্ণ বুদ্ধিবৃত্তিক একটি ধারণাঃ
কেউই মারা যেতে চায় না। এমনকি যে লোকটি স্বর্গে যেতে চায় সেও সেখানে যাবার জন্য মরতে রাজী নয়। কিন্তু তারপরও মৃত্যুই আমাদের সবার শেষ গন্তব্য। কেউ কোনদিন এটা এড়াতে পারেনি, এবং এমনই হওয়া উচিত, কারণ 'মৃত্যু' হচ্ছে জীবনের অন্যতম সেরা আবিষ্কার। এটা জীবনের পরিবর্তনের মাধ্যম। এটা পুরাতনকে মুছে ফেলে নতুনের জন্য জায়গা করে দেয়। এই মুহূর্তে সেই নতুন হলে তোমরা, কিন্তু একটা নাতিদীর্ঘ সময় পর তোমরাও পুরাতন হয়ে মুছে যাবে। এমনভাবে বলার জন্য আমি দুঃখিত, কিন্তু এটাই অপ্রিয় সত্য।
তোমাদের সময় খুবই সংক্ষিপ্ত, তাই অন্য মানুষের জীবন যাপন করে এটা নষ্ট কোর না। অন্য কারও মতাদর্শের ফাঁদে আটকা পড়ে নিজের জীবন কাটিয়ে দিও না। তোমার অন্তরের কণ্ঠস্বর যেন অন্যদের মতামতের নীচে চাপা পড়ে না যায়। আর সবচেয়ে যেটা গুরুত্বপূর্ণ, তোমার মন এবং হৃদয়ের বোধকে অনুসরণ করার সাহস রেখো। তারা ঠিক জানে তুমি কী হতে চাও। বাকি সবকিছু এখানে অর্থহীন।
আমি যখন যুবক ছিলাম, তখন দ্য হোল আর্থ ক্যাটালগ নামে একটি অসাধারণ পত্রিকা বের হত যেটা ছিল আমাদের প্রজন্মের একটি ধর্মগ্রন্থের মত। মেনলো পার্ক— যেটা এখান থেকে বেশ কাছেই— সেখানে স্টুয়ার্ট ব্র্যান্ড নামে একজন ব্যক্তি এটা প্রকাশ করতেন। তিনি তাঁর কাব্যময়তার স্পর্শে এই পত্রিকাটিকে জীবন্ত করে তুলেছিলেন। ষাটের দশকের শেষভাগের কথা, তখন ছিল না কোন কম্পিউটার অথবা ডেস্কটপ পাবলিশিং, তাই এর পুরোটুকুই করা হত টাইপরাইটার, কাঁচি আর পোলারয়েড ক্যামেরা দিয়ে। গুগল চালু হওয়ার পয়ত্রিশ বছর আগে এটা ছিল অনেকটা পেপারব্যাক গুগলের মতঃ এটা ছিল আদর্শবাদী, দারুণ সব টুলস্ আর অসংখ্য চমৎকার ভাবনা দিয়ে পরিপূর্ণ।
স্টুয়ার্ট এবং তাঁর টিমের ব্যবস্থাপনায় দ্য হোল আর্থ ক্যাটালগ-এর বেশ কিছু সংখ্যা বের হয়েছিল এবং যখন এটার সময় ফুরিয়ে এল, তাঁরা একটি শেষ সংখ্যা প্রকাশ করলেন। এটা ছিল সত্তর দশকের মধ্যভাগ এবং আমি ছিলাম তোমাদের বয়সী। সেই বিদায়ী সংখ্যার ব্যাক-কভারে ভোরবেলার একটি গ্রাম্য পথের ছবি ছিল, যেমনটি তোমরা ভ্রমণে বেরিয়ে অনেকেই দেখে থাকবে যদি তোমরা একটু এ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় হও। এর নীচে ছিল এই কথাগুলোঃ 'ক্ষুধার্ত থেকো, বোকা থেকো'। এটা ছিল তাদের বিদায়ী বার্তা। ক্ষুধার্ত থেকো, বোকা থেকো। আমি নিজের জীবনে সবসময় এটাই চেয়েছি। আর আজ যেহেতু তোমরা গ্রাজুয়েট হয়ে নতুন জীবনে প্রবেশ করতে যাচ্ছ, এই একই শুভকামনা তোমাদের জন্য রইল।
ক্ষুধার্ত থেকো, বোকা থেকো।
তোমাদের সবাইকে অসংখ্য ধন্যবাদ।।
অনুবাদঃ
অরিন্দম গুস্তাভো বিশ্বাস
১৭ - ২৯ জানুয়ারী ২০১৫
খুলনা
ঋণস্বীকারঃ
২. স্টিভ
জবস্ — ওয়াল্টার আইজ্যাকসন
৩. ছবিঃ
এ্যাপেল.কম