পৃষ্ঠাসমূহ

২ নভে, ২০১৩

স্মৃতি-বিস্মৃতির তাজউদ্দীন আহমদ

বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। জন্মেছিলেন ঢাকার অদূরে কাপাসিয়ার দরদরিয়া গ্রামে, ১৯২৫ সালের ২৩শে জু্লাই। নানান ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে যে মানুষটি পরবর্তীকালে হয়ে উঠেছিলেন বাংলাদেশের যুদ্ধদিনের কান্ডারী, এক নিঃসঙ্গ সারথী।

ছোট্টবেলাতেই এই মানুষটি দেশপ্রেম আর রাজনীতির দর্শন পেয়েছিলেন ব্রিটিশ রাজবন্দীদের কাছ থেকে। মানবতাবাদী এই মানুষটি স্কুলের ছুটিতে বাড়িতে ফিরেও লেগে যেতেন কলেরা রোগীদের সেবা শুশ্রষা করার কাজে। উন্নত জীবনযাপনের স্বপ্নপূরণের জন্য লেখাপড়া করার ইচ্ছা তাঁর মধ্যে ছিলনা, তাঁর স্বপ্ন ছিল রাজনীতি করার, যে রাজনীতি হবে মানুষের জন্য। তবু অসাধারণ মেধার সাহায্যে তিনি কৃতিত্বের সাথে পেরিয়ে গিয়েছিলেন শিক্ষাজীবনের প্রতিটি ধাপ। রাজনীতিতে সক্রিয় হবার কারণে শিক্ষাজীবনের ধারাবাহিকতায় ছেদও পড়েছিল বারবার। ধীরে ধীরে এই প্রচারবিমুখ মানুষটি নিজগুনে হয়ে উঠেছিলেন তৎকালীন আওয়ামী লীগের এক অপরিহার্য কর্মী, শেখ মুজিবুর রহমানের একান্ত সহচর।

এরপর ২৫শে মার্চের কালরাত্রিতে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিয়ে স্বাধীন দেশের প্রতিনিধি হিসেবে প্রবেশ করেছিলেন ভারতে এবং ইন্দির গান্ধির সাথে দেখা করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের সর্বপ্রকার সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি আদায় করে নিয়েছিলেন। এমনকি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বিভিন্ন বিষয়ে পি. এন. হাকসার, ডি. পি. ধর এর মত তৎকালীন বাঘা বাঘা ভারতীয় ব্যুরোক্র্যাটদের সাথে আলোচনায় বসে তাঁর মেধাবী বিশ্লেষণী ক্ষমতার বলে তাদের সমীহের পাত্র হয়েছিলেন। নয় মাস অক্লান্ত পরিশ্রমে কূটনৈতিক, রাজনৈতিক এবং আন্তর্জাতিক নানান চক্রান্ত-ষড়যন্ত্রকে ব্যর্থ করে দিয়ে বাংলাদেশের জন্য জয় করে এনেছিলেন স্বাধীনতার লাল সূর্য। অতঃপর তাঁর মুজিব ভাইয়ের হাতে স্বাধীন দেশের ক্ষমতাভার তুলে দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়েছিলেন।

স্বাধীন দেশে তাজউদ্দীন আহমদ সফলভাবে একজন অর্থমন্ত্রীর দ্বায়িত্ব পালন করেন। এরপর ১৯৭৪ সালের শেষের দিকে বিভিন্ন আদর্শগত মতানৈক্যে বিদায় নেন মন্ত্রীসভা থেকে। তাঁর দুঃখ ছিল একটাই, মুক্তিযুদ্ধের উত্তাল সেই নয় মাসের গল্প তাঁর মুজিব ভাইকে বলতে না পারার দুঃখ। ১৫ই আগষ্ট ঘাতকদের হাতে শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হওয়ার পর তাজউদ্দীন আহমদ আক্ষেপ করে বলেছিলেন― 'মুজিব ভাই জেনে গেলেন না কে তাঁর বন্ধু ছিল আর কে তাঁর শত্রু'।

এরপর বিশেষ আইনে গ্রেফতার হয়ে ১৯৭৫ সালের ৩রা নভেম্বর ভোরে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ভেতরে তাঁর দীর্ঘদিনের সহকর্মী সৈয়দ নজরুল ইসলাম, এম. মনসুর আলী এবং এ. এইচ. এম. কামরুজ্জামানের সাথে ঘাতকদের গুলিতে নিহত হন তাজউদ্দীন আহমদ।

আত্মপ্রচারবিমুখ তাজউদ্দীন স্বভাবতই যথেষ্ট আলোচিত নন, নন্দিতও নন। হয়ত একদিন ইতিহাস তার নিজ উদ্যেগেই জাতির এই বিস্মৃতপ্রায় সন্তানকে তুলে আনবে তার প্রাপ্য মর্যাদার আসনে। কিন্তু তাজউদ্দীন কি চেয়েছিলেন? তিনি বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন এই কি ছিল তাঁর বাসনা? তিনি তো বলেই দিয়েছেন, 'মুছে যাক আমার নাম, তবু বেঁচে থাক বাংলাদেশ'। হয়ত বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো এক গর্বিত বাংলাদেশের মধ্যেই তিনি বেঁচে থাকতে চেয়েছিলেন, যে বাংলাদেশ মাথা নোয়াতে শেখেনি কখনও।।

শেষকথাঃ তাজউদ্দীন আহমদকে নিয়ে বিভিন্ন বই, পত্রিকায় প্রকাশিত আর্টিকেল ইত্যাদি থেকে চুম্বক অংশগুলো দীর্ঘদিন ধরে সংগ্রহ করেছিলাম, যেগুলো পাঠ করে মূলত তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, সিদ্ধান্ত গ্রহন, ভবিষ্যৎ ধারণা করবার ক্ষমতা ও একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে তাঁর ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক দর্শনের পরিচয় পাওয়া যায়। সেগুলোর মধ্যে যতগুলো পাওয়া গেল সবই একত্রে করে তুলে দিলাম এখানে। তাজউদ্দীন আহমদের রাজনৈতিক ও মানবিক স্বরূপ বুঝতে এগুলো কিছুটা সহায়ক হবে বলে আমি মনে করি। উল্লেখ্য, কোন ঘটনা বা সময়ক্রম এখানে অনুসরণ করা হয়নি। প্রত্যেকটি পয়েন্ট যেহেতু আলাদা তাই কিছু জায়গায় তথ্যের পুনরাবৃত্তি থাকতে পারে, তবে উক্ত পয়েন্টের সাথে প্রাসঙ্গিক বলে অবিকৃতভাবেই তুলে দিলাম।


.
১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাতে বাসা থেকে বেরিয়ে যাবার আগে স্ত্রীর উদ্দেশ্যে তাজউদ্দীন আহমদের শেষ কথা ছিল ― 'তোমরা কি করবে কর। আমি চলে গেলাম'।

এরপর ২৮শে মার্চ রাতে মুসা সাহেব মিসেস জোহরা তাজউদ্দীনের হাতে একটা চিরকূট পৌঁছে দেন। কুড়িয়ে নেয়া একটা কাগজে তাজউদ্দীন লিখেছিলেনঃ 'যাবার সময় বলে আসতে পারিনি। মাফ করে দিও। তুমি ছেলেমেয়ে নিয়ে সাড়ে সাত কোটি মানুষের সাথে মিশে যাও। কবে দেখা হবে জানি না.........মুক্তির পর।'

পরে তাজউদ্দীন আহমদ রহমত আলি নামের একজনকে তার পরিবারের খবর জিজ্ঞেস করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, তারা বেঁচে আছে নাকি মরে গেছে তার সঠিক খবরটা তাকে জানাতে। কারণ তারা বেঁচে থাকলে তার ভাল লাগবে, আর মরে গিয়ে থাকলে মুক্তিযুদ্ধের মাঝে তিনি সান্ত্বনা খুঁজে পাবেন।

[ আমার ছোটবেলা ১৯৭১ এবং বাবা তাজউদ্দীন আহমদ ― সিমিন হোসেন রিমি ]


.
আব্বুকে ঘিরে আছে কত মানুষ। আব্বু মুক্তিযুদ্ধের কথা বলছেন। এই শিশু দেশকে কিভাবে গড়ে তুলতে হবে, সে কথা বলছেন।

সমবেত মানুষের মধ্যে থেকে কয়েকজন আব্বুকে বলেছিলেনঃ আর চিন্তা কি, তাজউদ্দীন ভাইসাবের পোড়া ভিটায় নতুন বাড়ি উঠবে।

এই কথার উত্তরে আব্বু বললেনঃ যত দিন পর্যন্ত এই বাংলাদেশের ক্ষতিগ্রস্থ মানুষের মাথা গোঁজার ঠাঁই না হবে, ততদিন এই ভিটায় বাড়ি উঠবে না (আজও সেখানে বাড়ি হয়নি)

আব্বু বললেনঃ মনে রেখ, আমি শুধু এই এলাকার মন্ত্রী না, আমি সমস্ত বাংলাদেশের। এখন তোমাদের দ্বায়িত্ব আগের চাইতে অনেক বেশী। কারন সমস্ত দেশের মানুষ তোমাদের কাপাসিয়ার এই মন্ত্রীর দিকে তাকিয়ে থাকবে। আমি স্বার্থপরের মত আমার এলাকার উন্নয়নের কাজে হাত দিতে পারি না। আমাকে সমস্ত দেশে সব কিছু সমানভাবে ভাগ করে দিতে হবে।

[ আমার ছোটবেলা ১৯৭১ এবং বাবা তাজউদ্দীন আহমদ ― সিমিন হোসেন রিমি ]


.
১০ই জানুয়ারী ১৯৭২, পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডন সফর করে স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরলেন বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধু-তাজউদ্দীন দু'জনেই আবেগে আপ্লুত। কিন্তু তাদের দুইজনের আবেগআপ্লুত হয়ে পড়ার কারণ কিন্তু ভিন্ন। বঙ্গবন্ধু কাঁদছেন কারন তিনি তার স্বপ্নের স্বাধীন সোনার বাংলায় ফিরে এসেছেন। তাজউদ্দীন কাঁদছেন কারণ তিনি তার মুজিব ভাইকে পাকিস্তানীদের হাত থেকে ফিরিয়ে আনতে পেরেছেন। যে মুজিব ভাইয়ের ব্যাপারে তিনি আলী তারেক'কে বলেছিলেন যে, তিনি বাংলাদেশকে নয় বঙ্গবন্ধুকে বেশী ভালবাসেন, তার কারণ বঙ্গবন্ধুকে না ভালবেসে কেউ বাংলাদেশকে ভালবাসতে পারে না।

বঙ্গবন্ধু যে তাজউদ্দীন আহমদের মনের মণিকোঠার ঠিক কোন জায়গায় অবস্থান করতেন সেটা নিচের দুইজনের চোখে দেখা অভিজ্ঞতা থেকে প্রতীয়মান হয়ে ওঠেঃ

তাজউদ্দীন ভাই বঙ্গবন্ধুকে নিঃস্বার্থভাবে ভালবাসতেন। প্রথমদিকে তাঁকে দেখেছি প্রায় ছলছল চোখে বলছেন যে, মুজিব ভাই, আপনি আমাকে এত বড় বিপদে ফেলে রেখে গেলেন। এটা তিনি নিজেকে বলতেন। তিনি যে অফিসে বসতেন সেখানে কোথা থেকে বহু কষ্ট করে বঙ্গবন্ধুর একটা ছবি সংগ্রহ করে সেটাকে বাঁধিয়ে রাখলেন। ৬ ডিসেম্বর ভারত বাংলাদেশকে যখন স্বীকৃতি দিল সেদিন সাংবাদিকেরা তাঁকে জিজ্ঞেস করতে এলেন যে, আপনার প্রতিক্রিয়া কি? তখন তিনি বললেন, 'আমার কাছে আপনারা জিজ্ঞেস করতে এসেছেন আমার প্রতিক্রিয়া কি? আমি তো মাত্র ধাত্রীর কাজ করেছি। এবং যে ধাত্রী সন্তান ভূমিষ্ট হবার খবর পিতার কাছে পৌঁছাতে পারে না, সে ধাত্রীর যে রকম মনের অবস্থা, আমার অবস্থাও সেরকম'। এটা বলে তিনি কেঁদে ফেললেন। বললেন যে, 'মুজিব ভাইয়ের কাছে আমি খবরটা পৌঁছাতে পারছি না, এর চাইতে বড় দুঃখ আমার আর কি আছে!'

― আমীর-উল ইসলাম

মনে আছে, ৮ জানুয়ারী ১৯৭২, বঙ্গভবনে তাজউদ্দীন সাহেবের টেবিলের পাশে বসে আমি কাজ করছি, টেলিফোন বেজে উঠল। আমি রিসিভার তুলতেই অপারেটরের কন্ঠস্বর, 'প্রধানমন্ত্রীকে দিন, লন্ডন থেকে কল, বঙ্গবন্ধু'। আমি চীৎকার করে উঠলাম, ওই পাশ থেকে ভেসে এল, 'তাজউদ্দীন?' আমি দ্রুত রিসিভারটা তাজউদ্দীন সাহেবকে দিলাম। তাকিয়ে রইলাম তার দিকে, অত বড় একজন মানুষ, যুদ্ধবিজয়ী প্রধানমন্ত্রী – দরদর করে চোখ দিয়ে পানি ঝরছে। ঠিকমত কথাও বলতে পারছেন না।

...বঙ্গবন্ধু ফিরে এলেন। তার পরদিন তাজউদ্দীন আহমদ বললেন, 'হি হ্যাজ ডিজায়ার্ড টু বি দা প্রাইম মিনিষ্টার এবং আমি তাঁকে তা দিয়ে দিচ্ছি'। আমার এখনও চোখে ভাসে, ১২ জানুয়ারী '৭২, বঙ্গভবনের দরবার হলের ডান দিকের বসবার সারিতে তাজউদ্দীন আহমদ বসা। উৎফুল্ল মানুষটি।

― মোহাম্মদ নুরুল কাদের

[ তাজউদ্দীন আহমদ ― আলোকের অনন্তধারা (প্রথম খন্ড) ]


.
এদিকে পরিচিত নানাজন প্রায়ই আমাদের বাসায় আসেন। তাঁদের কাছ থেকেই আব্বুর খবর পাই। তিনি ২৪ ঘন্টার মধ্যে ২০ ঘন্টাই কাজ করেন, বিভিন্ন মানুষের সাথে দেখা করেন। কত সহস্র সমস্যার পাহাড় অতিক্রম করেন। মাঝে মাঝে বেশী কাজের চাপে চেয়ারে একটু ঘুমিয়ে নেন। রণাঙ্গনে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের খবর নেন, তাঁদের সাথে এক পাতে খেয়ে মনে সাহস যোগান। কোন এক বিদেশী ভদ্রলোকের সাথে আব্বুর বেশ কয়েকবার দেখা হয়। শেষ পর্যন্ত একবার তিনি নাকি বলেই ফেলেছিলেন ― তাজউদ্দীন সাহেব, আপনি কোন নেশা না করে কি করে রাত দিন এমন খাটতে পারেন?

আব্বু প্রত্যুত্তরে শুধু একটু হেসে জবাব দিয়েছিলেন, আমার দেশ, আমার দেশের জন্য কর্তব্যবোধ আমাকে শক্তি যোগায়।

[ আমার ছোটবেলা ১৯৭১ এবং বাবা তাজউদ্দীন আহমদ ― সিমিন হোসেন রিমি ]


.
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সময়ের পার্থক্য ছিল ৩০ মিনিট। বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার ভারতের মাটিতে থেকে কাজ করত, চলত ভারতের সময়ে। কিন্তু তাজউদ্দীন আহমদ কোনো দিন তাঁর হাতঘড়ির সময় পরিবর্তন করেননি, সেটি চলত বাংলাদেশের সময়ে।

মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস পাকিস্তানি দানবেরা এই দেশের মাটিতে ঘাঁটি গেড়ে বসেছিল। তখন আকাশে শকুন উড়ত, নদীর পানিতে ভেসে বেড়াত ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহ, শুকনো মাটিতে দাউ দাউ করে জ্বলত আগুনের লেলিহান শিখা, বাতাস ভারী হয়ে থাকত স্বজনহারা মানুষের কান্নায়। শুধু বাংলাদেশের সময়টুকু তারা কেড়ে নিতে পারেনি। তাজউদ্দীন আহমদ পরম মমতায় সেই সময়টুকুকে তাঁর হাতঘড়িতে ধরে রেখেছিলেন।

ঘাতকের বুলেট তাজউদ্দীন আহমদের হৎস্পন্দনকে চিরদিনের জন্য থামিয়ে দিয়েছে, কিন্তু তাঁর হাতের ঘড়িতে ধরে রাখা বাংলাদেশের সময়টিকে কোনো দিন থামাতে পারবে না।

যত দিন বাংলাদেশ থাকবে, তত দিন তাজউদ্দীন আহমদের ঘড়ি আমাদের হূদয়ে টিকটিক করে চলতে থাকবে। চলতেই থাকবে।

[ তাজউদ্দীন আহমদের হাতঘড়ি ― মুহম্মদ জাফর ইকবাল ]


.
আব্বু বলতেন― 'তাজউদ্দীন ক্ষনিকের হাততালি আর বাহবার জন্য রাজনীতি করেনি। আজ থেকে ৫০ বছর, ১০০ বছর কি তারও বেশী সময় পরে যদি এই দেশের মানুষ বুঝতে পারে তাজউদ্দীন তাঁর জন্মভূমিকে ভালবেসে শুধুমাত্র মানুষের মঙ্গলের জন্যই কাজ করে গেছেন, তখনই তিনি সার্থক হবেন'।

আব্বু বলতেন ― 'একটা কষ্ট আমার মনে রয়েই গেল। যে মুজিব ভাইকে আমি তিল তিল করে আমার মনে ধারণ করেছিলাম, যাকে আমি কোনদিন নিজ থেকে আলাদা করে ভাবতে পারিনি, সেই মুজিব ভাই একটা দিনের জন্যও আমার কাছ থেকে জানতে চাইলেন না, তাজউদ্দীন, ১৯৭১-এ আমি যখন ছিলাম না তোমরা তখন কি করে কি করলে? একবারও বললেন না, তাজউদ্দীন তুমি বল, আমি ১৯৭১ এর কথা শুনব'।

[ আমার ছোটবেলা ১৯৭১ এবং বাবা তাজউদ্দীন আহমদ ― সিমিন হোসেন রিমি ]


.
দাদী বলতেন, একবার গ্রামে মহামারী দেখা দিয়েছিল, আব্বু তখন ক্লাস সেভেনের ছাত্র। আমাদের বাড়িতে যেতে নদীর ঘাটে প্রথম যে বাড়িটা সেই বাড়ির কেউ সুস্থ্য ছিল না। স্কুল ছুটিতে বাড়িতে এসে এই অবস্থা দেখে আব্বু ছুটে এসে বলেনঃ মা, তুমি ওদের জন্য খাবার রান্না করে দাও, আমি ওদেরকে সুস্থ্য করে তুলব।

দাদী ছেলেকে মনেপ্রাণে বুঝতেন। তাই প্রতিদিন খাবার রান্না করে দিতেন। আব্বু সেই খাবার নিয়ে গিয়ে নিজ হাতে ওদের খেতে দিতেন। খাওয়া শেষ হলে সমস্ত থালাবাসন নিজ হাতে নদীর পানিতে ধুয়ে শুকিয়ে রেখে আসতেন। পরিষ্কার পানি দিতেন ওদের খাবার জন্য। এইভাবে সেবা করে আব্বু ওদের সুস্থ্য করে তোলেন।

[ আমার ছোটবেলা ১৯৭১ এবং বাবা তাজউদ্দীন আহমদ ― সিমিন হোসেন রিমি ]


.
তিনি খুব আত্মপ্রচারবিমুখ ছিলেন। নিজেকে খুব আড়াল করে রাখতে চাইতেন। নিজের ভূমিকাকে গোপন করে রাখতেন। যেটা তার চরিত্রের বৈশিষ্ট্য ছিল। এই বৈশিষ্ট্য যুদ্ধের সময়ও প্রতিটি ক্ষেত্রে দেখা গেছে।

তার প্রয়োজন ছিল খুব সীমিত। প্রয়োজন খুব কম থাকত। দুটো ট্রাউজার, দুটো হাওয়াই শার্ট, কয়েকটা গেঞ্জি, মোজা, স্যান্ডেল― এগুলি ছিল তার যুদ্ধকালীন সম্পত্তি। এগুলো ছাড়া তো কিছু তার ছিলনা। আর একটা ছোট্ট রেডিও। কাপড়গুলো তিনি নিজের হাতে কাচতেন। যখনই গোসল করতেন, তখনই নিজে কেচে সেগুলো আবার শুকাতে দিতেন। তাঁর নিজের ব্যাপার যাতে কারো জন্য বোঝা না হয়, কোন বেয়ারা বা পিয়ন বা অন্য কোন লোক বা বিএসএফ-এর কোন কর্মচারীর, এদিক থেকে তিনি খুব সজাগ থাকতেন। তাঁর নিজের কাজে যেন তারা ব্যাস্ত না হয়। কাজেই তাঁর নিজের কাজের দ্বায়িত্ব কাউকে বহন করতে দিতে চাইতেন না। নিজের বিছানাটা নিজে ঠিক করতেন, নিজের জুতাটা নিজে পালিশ করতেন। পরের দিকে মকফুর নামের একজন পিয়ন ছিল। সে হয়ত জোর করে তাঁর গেঞ্জিটা নিয়ে কাচত, বা জোর করে জুতাটা নিয়ে ব্রাশ করত। কিন্তু তিনি নিজের ব্যাক্তিগত কাজ সহজে কাউকে দিয়ে করাতেন না।

― আমীর-উল ইসলাম

[ তাজউদ্দীন আহমদ ― আলোকের অনন্তধারা (প্রথম খন্ড) ]


.
দেশের উন্নয়ন সাধনের জন্য নিজেদেরকেই তাহার মূল্য যোগাইতে হইবে এবং ব্যয়ও বহন করিতে হইবে। সমাজতান্ত্রিক রূপান্তরের লক্ষ্যে পৌঁছাইতে হইলে এক সর্বাত্মক প্রয়াসের প্রয়োজন। ইহার জন্য নেতৃত্ব, জনগণ ও সম্পদকে সংগঠিত করার ক্ষেত্রে সবরকমের প্রচেষ্টা চালাইতে হইবে। গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদের বাজেট অধিবেশনে ১৯৭৩-৭৪ সালের বার্ষিক বাজেট পেশকালে অর্থ ও পাটমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদ তাহার ভাষণে উপরোক্ত মন্তব্য প্রকাশ করেন। তিনি বলেন যে, প্রশাসন ও জনগণকে নতুন মূল্যবোধে উদ্ধুদ্ধ হইতে হইবে।

দৈনিক ইত্তেফাকঃ জুন ১৫, ১৯৭৩, শুক্রবার

[ তাজউদ্দীন আহমদ ― ইতিহাসের পাতা থেকে ]


১০.
সুন্দর কল্যাণময় সমাজ গড়ে তোলা বক্তৃতা মঞ্চ থেকে উঠে আসে না। এ জন্য প্রয়োজন কাজ করার।

― তাজউদ্দীন আহমদ


১১.
বক্তৃতা কমাতে হবে। এখন ভেবে দেখতে হবে বক্তৃতায় যা বলা হয়েছে তা করা হয়েছে কিনা!

― তাজউদ্দীন আহমদ


১২.
হঠাৎ একটি ১২/১৩ বছরের কিশোরকে হাতে অটোমেটিক মেশিনগান নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মূহুর্তের জন্য প্রধানমন্ত্রী হতবাক। ওর গালে ছোট্ট একটি আদর করে জিজ্ঞেস করলেন- 'এই খোকা, তোমার বয়স কত?' 'স্যার, আঠার'। বুঝলাম ছেলেটা মিথ্যে বলল। ঠাট্টা করে প্রধানমন্ত্রী বললেন, 'তুমি ফিরে যাও তোমার যুদ্ধের দরকার নেই'। অপলক নেত্রে চেয়ে দেখলাম― কিশোরটির দু'চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। আকুতি জানিয়ে বলল, 'আমাকে বাদ দেবেন না স্যার, এগিয়ে চলার পথে আমি পেছু হটতে শিখিনি'। ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে প্রধানমন্ত্রী বললেন, 'কেউ তোমায় বাদ দেবে না ভাই'। পরে সেক্টর কমান্ডার জানালেন, ঐ বাচ্চা ছেলেটি পরপর সাতটি গুরুপ্তপূর্ণ অপারেশনে সাফল্য নিয়ে এসেছে।

[ রণাঙ্গনে প্রধানমন্ত্রী (মুক্তিযুদ্ধের সময় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও প্রচার দফতর থেকে প্রকাশিত একটি প্রচার পুস্তিকা) ]


১৩.
When I go to my office in Motijheel from my Gulshan residence, I pass through Shaheed Tajuddin Road in the Tejgoan Industrial Area. It always pains me that Sadeque Hossain Khoka, who had honoured a number of freedom fighters with streets named after them, had thought it fit to honour Tajuddin, who made the supreme sacrifice for the nation, with a road in the backyard of Dhaka. Maybe, Tajuddin is better off as an unsung hero remaining clear of all political controversy.

[ Remembering Tajuddin ― M. Matiul Islam ]


১৪.
হাসপাতালের বিছানায় বসে অপলক নেত্রে প্রধানমন্ত্রীর দিকে তাকিয়ে ছিল একজন সৈনিক। হানাদার পশুদের একটি মর্টার শেল ওর দু'টি হাতকে উড়িয়ে নিয়ে গেছে। প্রধানমন্ত্রী ছুটে গিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে বললেন, 'বল তুমি কি চাও?' ধীর, শান্ত অথচ ইস্পাত কঠিন কন্ঠে ও পাল্টা প্রশ্ন করল, 'পারবেন আমি যা চাই তা আমাকে দিতে'। প্রধানমন্ত্রী নির্বাক। ও বলল, 'স্যার, হৃদয়ের জ্বালা আমার থামেনি, আমি আবার যুদ্ধক্ষেত্রে যেতে চাই। প্লাষ্টিক সার্জারি করে আমার হাত দুটিকে ভাল করে দিন'। কয়েক মূহুর্তের জন্য আমরা সকলে স্থবির হয়ে গেলাম― মন ডেকে বলল, যে মাটি এমন বীর সন্তানকে জন্ম দিয়েছে সে মাটিতে হানাদার পশুদের কোন স্থান নেই।

[ রণাঙ্গনে প্রধানমন্ত্রী (মুক্তিযুদ্ধের সময় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও প্রচার দফতর থেকে প্রকাশিত একটি প্রচার পুস্তিকা) ]


১৫.
এই ঘটনাটি তাঁর যে সচিব ছিল মতিউর রহমান, তার কাছ থেকে শোনা। উনি একদিন সকালে অফিসে এসে দেখে যে প্রধানমন্ত্রী নেই। তো ও খুঁজতে লাগল। খুঁজতে খুঁজতে গিয়ে দেখে ৮ নম্বর থিয়েটার রোডের চত্বরে একটা আউটহাউজে তাজউদ্দীন সাহেবের পিয়ন থাকত। পিয়ন সকালবেলা আসেনি তাই উনি খুঁজতে গেছেন, গিয়ে দেখেন তার জ্বর। মতিউর রহমান গিয়ে দেখে, তাজউদ্দীন সাহেব বদনা দিয়ে পিয়নের মাথায় পানি ঢেলে দিচ্ছেন। এই হচ্ছে ওঁর মানবিক গুনের কথা।

― অধ্যাপক আনিসুজ্জামান

[ তাজউদ্দীন আহমদঃ নিঃসঙ্গ সারথী ]


১৬.
আমার একদিনের কথা মনে পড়ে। আমেরিকার পক্ষ থেকে বাংলাদেশের জন্য শর্তসাপেক্ষে কিছু সাহায্যের প্রস্তাব নিয়ে একজন প্রতিনিধি তাঁর(তাজউদ্দীন আহমদ) সঙ্গে দেখা করেন। তখন তিনি স্পষ্টভাবে তাঁকে বলেছিলেন, 'বেগারস মে নট হ্যাভ আ চয়েস, বাট উই বাংলাদেশ পিপল, উই আর নট বেগারস্, উই হ্যাভ অ্যাচিভড্‌ আওয়ার ইনডিপেনডেন্স থ্রু আ ব্লাডি স্ট্রাগল অব লিবারেশান। তাই কোন শর্তযুক্ত সাহায্য নিতে আমরা ইচ্ছুক নই'।

― আলী তারেক

[ তাজউদ্দীন আহমদ ― আলোকের অনন্তধারা (প্রথম খন্ড) ]


১৭. বঙ্গবন্ধু তাজউদ্দীনঃ পরষ্পরের দৃষ্টিতে
শেখ মুজিবুর রহমান তখন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় জেলে। মামলা তুলে না নিলে তিনি রাউন্ড টেবিল কনফারেন্সে যাবেন না এইটা সিদ্ধান্ত নিলেন, কিন্তু রাউন্ড টেবিল কনফারেন্সের এজেন্ডা হিসেবে সেইটা উপস্থাপন করবেন কে? নেতারা সবাই তো জেলে। তখন তিনি কিছুক্ষন চিন্তা করে আমিরুল ইসলামকে বললেন, 'তাজউদ্দীনকে যদি বের করে নিয়ে আসতে পার, সে এই কাজটা করতে পারবে'।।

১৯৭০ সালের নির্বাচনের আগে তাজউদ্দীন আহমদের একটি এক্সিডেন্ট হয়। তিনি পায়ে আঘাত পান। বঙ্গবন্ধু তখন ঢাকার বাইরে ছিলেন। এই খবর শুনে তিনি পাগলপ্রায় হয়ে ছুটে আসেন যে তাজউদ্দীনের এত বড় একটা এক্সিডেন্ট হয়ে গেছে। তাজউদ্দীন আহমদকে নিজ চোখে দেখে তারপর তিনি দুশ্চিন্তামুক্ত হন।।

জোহরা তাজউদ্দীনকে বঙ্গবন্ধু প্রায়ই বলতেন, 'লিলি, ও যেন কোন কিছুতে ডিস্টার্বড না হয় এ ব্যাপারে কিন্তু খুব খেয়াল রাখবে, কারণ ও হল আমাদের সব থেকে কাজের মানুষ'।।

১৯৭১ এর ৬ ডিসেম্বর ভারত বাংলাদেশকে যখন স্বীকৃতি দিল সেদিন সাংবাদিকেরা তাজউদ্দীন আহমদকে জিজ্ঞেস করতে এলেন যে, আপনার প্রতিক্রিয়া কি? তখন তিনি বললেন, 'আমার কাছে আপনারা জিজ্ঞেস করতে এসেছেন আমার প্রতিক্রিয়া কি? আমি তো মাত্র ধাত্রীর কাজ করেছি। এবং যে ধাত্রী সন্তান ভূমিষ্ট হবার খবর পিতার কাছে পৌঁছাতে পারে না, সে ধাত্রীর যে রকম মনের অবস্থা, আমার অবস্থাও সেরকম'। এটা বলে তিনি কেঁদে ফেললেন। বললেন যে, 'মুজিব ভাইয়ের কাছে আমি খবরটা পৌঁছাতে পারছি না, এর চাইতে বড় দুঃখ আমার আর কি আছে!'।।

মুক্তিযুদ্ধের পর আলী তারেক তাজউদ্দীন আহমদকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, 'তাজউদ্দীন ভাই, আপনি কাকে বেশী ভালবাসেন, বাংলাদেশকে না বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে?'। তাজউদ্দীন উত্তর দিয়েছিলেন, 'আলী তারেক, আমি বঙ্গবন্ধুকে বেশী ভালবাসি'। তিনি বোঝাতে চেয়েছিলেন যে, বঙ্গবন্ধুর মধ্য দিয়েই তিনি বাংলাদেশকে ভালবাসেন।।

তাজউদ্দীন বলতেন, 'জীবনে যা অর্জন করেছি, সব মুজিব ভাইয়ের খাতায় জমা দিয়েছি'।।

[ তাজউদ্দীন আহমদ ― আলোকের অনন্তধারা(প্রথম খন্ড) এবং 'তাজউদ্দীন আহমেদঃ নিঃসঙ্গ সারথি' তথ্যচিত্র ]


১৮.
আমার মনে হয়, তাজউদ্দীন যদি হাল না ধরতেন, কোনদিন বাংলাদেশ স্বাধীন হতে পারত না। রুস্তমজী আর আমি গিয়েছি দমদম এয়ারপোর্টে ওঁদের বিদায় দেবার জন্য। তাজউদ্দীন সাহেবকে রুস্তমজী বললেন, 'Sir, now that you are going back, we are looking forward to eternal friendship with Bangladesh'. তাজউদ্দীন উত্তর দিলেন, 'Yes, eternal friendship as equals'.

He was a statesman. He was not a politician, he was a statesman.

― গোলোক মজুমদার

[ তাজউদ্দীন আহমদঃ নিঃসঙ্গ সারথী ]


১৯.
বাংলাদেশ তখনও বিশ্বব্যাংকের সদস্য হয়নি। ১৯৭২ সালের ২৬ জানুয়ারী ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবসে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে তাজউদ্দীন আহমদ গেছেন দিল্লীতে। মুক্তিযুদ্ধে মার্কিন ভূমিকার জন্য তাজউদ্দীন যে বিশ্ব ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট রবার্ট ম্যাকনামারা'কে ঠিক পছন্দ করেন না সেটা ভারত সরকার বেশ ভালভাবেই জানত। তাই তারাও সেই অনুষ্ঠানের আসন বিন্যাস এমনভাবে করেছে যে যেখানে ম্যাকনামারাকে বসিয়েছে ঠিক তার পাশেই তাজউদ্দীন আহমদের সিট। তাজউদ্দীন আহমদ একটা কথাও বললেন না, এমনকি ঘুরেও তাকালেন না। ম্যাকনামারা কয়েকবার উনার দিকে তাকালেন, ভাবটা এমন যে কথা বললে আমি এখনই কথা বলব।

এরপর ফেব্রুয়ারিতে ম্যাকনামারা আসবেন ঢাকায়। তাকে রিসিভ করতে তাজউদ্দীন সাহেব বঙ্গবন্ধুকে তো যেতে দিলেনই না, নিজেও গেলেন না, প্ল্যানিং কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যানকেও তিনি যেতে দিলেন না, শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্ণর'কে পাঠানোর ব্যাপারে তিনি সন্মত হলেন।

ম্যাকনামারা ঢাকায় আসার পর তাজউদ্দীন সাহেবের সাথে মিটিং এ বসে জানতে চাইলেন বাংলাদেশের জন্য কোথায় কি ধরণের সাহায্য দরকার। তাজউদ্দীন সাহেব বললেন, 'আমাদের যা দরকার তা আপনি দিতে পারবেন কিনা আমার সন্দেহ আছে'। ম্যাকনামারা বললেন, 'মিস্টার মিনিস্টার, আপনি বলুন, আমরা চেষ্টা করব দিতে'। তখন তাজউদ্দীন সাহেব বললেন, 'মিস্টার ম্যাকনামারা, আমার গরু এবং দড়ি দরকার। যুদ্ধের সময় গরু সব হারিয়ে গেছে। এখানে ওখানে চলে গেছে, মরে গেছে। পাকিস্তান যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছে, চাষীরা সব এদিক সেদিক পালিয়ে গেছে, তখন গরু হারিয়ে গেছে। এখন যুদ্ধ শেষ, চাষী ফিরেছে কিন্তু গরু নাই, তাই চাষ করবে কীভাবে? কাজেই আমাদের অগ্রাধিকার চাহিদা হল গরু।' ম্যাকনামারার চোখ-মুখ লাল হয়ে গেল। তাজউদ্দীন সাহেব বললেন, 'আর আমাদের সমস্ত দড়ি তো পাকিস্তানীরা নষ্ট করে ফেলেছে, এখন গরু পেলে গরু বাঁধতে দড়ি প্রয়োজন। গরু এবং দড়ি প্রয়োজন খুব তাড়াতাড়ি, না হলে সামনে জমিতে চাষ হবে না'। ম্যাকনামারার মুখ লাল হল বটে, কিন্তু পরে ফলাফল ভাল হয়েছিল।

তাজউদ্দীন আহমদ সাংঘাতিক দেশপ্রেমিক ছিলেন। তিনি বুঝতেন আমরা বড় দেশকে কিছু করতে পারব না। সেই ক্ষমতা আমাদের নেই। কিন্তু আমাদের আত্মসন্মানবোধ আছে, আমরা কারও দয়া চাই না, এই জিনিসটি তিনি বুঝিয়ে দিতে চেয়েছিলেন, আর কোন উদ্দেশ্য তার ছিলনা।

আরও পরে বিশ্বব্যাংকের একটি অফিসিয়াল ডিনারে তাজউদ্দীন আহমদ সম্পর্কে প্ল্যানিং কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান নূরুল ইসলাম সাহেবকে ম্যাকনামারা বলেছিলেন, 'He is probably the best finance minister at present in the world'.

[ তাজউদ্দীন আহমদ ― আলোকের অনন্তধারা(প্রথম খন্ড) থেকে আবু সাইদ চৌধুরী ও নূরুল ইসলাম এর সাক্ষাৎকার এবং 'তাজউদ্দীন আহমেদঃ নিঃসঙ্গ সারথি' তথ্যচিত্র ]


২০.
বঙ্গবন্ধুর ২৭ বছরের একনিষ্ঠ সহকর্মী তাজউদ্দীন। বিশ্ব ইতিহাস, ভূগোল ও রাজনীতি সম্পর্কে তিনি লেখাপড়া করেছেন প্রচুর। বিশ্ব ইতিহাসের বা বিশ্ব রাজনীতির যে কোন ঘটনা সাল তারিখ দিয়ে তিনি মূহুর্তের মধ্যে আপনাকে বলে দিতে পারবেন, অথবা বিশ্ব মানচিত্রের যে কোন অবস্থানের অবস্থিতি তিনি সাথে সাথে বলে দিতে পারবেন। আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ, ফরাসী বিপ্লব, রুশ বিপ্লব, চীনে কমিউনিষ্টদের ক্ষমতা দখল, মধ্যপ্রাচ্যে আরব-ইসরায়েল সংঘাত এবং ভিয়েতনাম ও আলজেরিয়ার মুক্তিযুদ্ধের সমস্ত ইতিহাসই যেন তার নখদর্পণে।

[ মুক্তিযুদ্ধের সময় 'জয় বাংলা' পত্রিকায় প্রকাশিত তাজউদ্দীন আহমদ সম্পর্কে একটি প্রতিবেদন ]


২১.
'মনে রাখবেন একটা দেশ চালাতে হলে তার সরকার কোনদিনই effective হবে না যদি না, তার পেছনে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান থাকে। আমার আওয়ামী লীগ যদি দুর্বল হয়ে যায় আমি মন্ত্রী, এই যে পতাকাটি উড়িয়ে যাই, বিভিন্ন ঘটনায় আমি লজ্জাবোধ করলে এই পতাকাটি হয়ত একটা টিটকারি হয়ে যাবে। টিটকারি হবে তখন যখন আমার আওয়ামী লীগ দুর্বল হবে। যখন আওয়ামী লীগ দুর্বল হবে না তখন কেউ টিটকারি দিতে সাহস পাবে না'।

― তাজউদ্দীন আহমদ

[ ২০শে জানুয়ারী ১৯৭৪ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের দ্বি-বার্ষিক কাউন্সিলের সমাপনী অধিবেশনে প্রদত্ত তাজউদ্দীন আহমদের ভাষণ ]


২২.
স্বাধীনতা সংগ্রামে লিপ্ত দূর্জয় সেনানীদের সাথে ব্যাক্তিগতভাবে আলাপ-আলোচনার পর বুড়িমারি স্কুলগৃহে প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর সাথে আগত অতিথিদের দুপুরের খাওয়া পরিবেশন করা হল। হঠাৎ উইং কমান্ডার বাসারকে ডেকে প্রধানমন্ত্রী জিজ্ঞাসা করলেন-'আমাদের যোদ্ধারা খেয়েছে?' উত্তর এল―'ওরা মাটির মধ্যে খেতে বসেছে'। একটি মূহুর্ত মাত্র। দেখলাম প্রধানমন্ত্রী আস্তে করে উঠে চলে গেলেন। সমস্ত জিনিসটাই বুঝতে পারলাম যখন বাইরে এসে দেখি একটি টিনের থালায় খাবার হাতে নিয়ে অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে বসে প্রধানমন্ত্রী পরম তৃপ্তির সাথে আহার করে চলেছেন। প্রধানমন্ত্রীর দুই পাশে উপবিষ্ট দু'জন মুক্তিযোদ্ধা সংকোচ ও জড়তায় খাবার কথা ভুলে অবাক নেত্রে চেয়েছিল। নিজের থালা থেকে দু'টি মাংসের টুকরা ওদের হাতে তুলে দিয়ে স্নিগ্ধ হাসি হেসে প্রত্যয়দৃঢ় কন্ঠে প্রধানমন্ত্রী বললেন- 'বাংলার সাড়ে সাত কোটি নর-নারীর প্রত্যেকেই আজ মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তি ও স্বাধীনতার এই যুদ্ধে আমি, তুমি, সে আর তিনি সবাই সমান'।

[ রণাঙ্গনে প্রধানমন্ত্রী (মুক্তিযুদ্ধের সময় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও প্রচার দফতর থেকে প্রকাশিত একটি প্রচার পুস্তিকা) ]


২৩.
'আমি এটাই দেখতে চাই যে, একজন সৎ রাজনৈতিক কর্মী কোন রকমের অন্যায় বা কোন রকমের দূর্নীতি না কোন রকমের স্বজনপ্রীতি তোষণবাদ এইগুলা না করে শুধুমাত্র নিজের কাজ, নিজের চরিত্র এবং নিজের জনসংযোগের মাধ্যমে রাজনীতিতে সার্থক হতে পারে― আমি এই জিনিসটা দেখাতে চাই। নির্বাচন বা রাজনীতির পদ দখল করতে আমার টাকা পয়সা খরচ করার কোন প্রয়োজন নেই। আর আমার সেই প্রবৃত্তিও নেই। আমি নিজের দেশের লোকের জন্য নিজের হয়ে খেটে, নিজের চারিত্রিক সততা দিয়ে, নিজের জনসংযোগ বলে নির্বাচিত হয়ে আসতে পারি কিনা এটাই আমি দেখতে চাই এবং নিজের কাছে সেটা প্রমাণ করতে চাই'

― তাজউদ্দীন আহমদ

[ তাজউদ্দীন আহমদ - আলোকের অনন্তধারা(প্রথম খন্ড) ]


২৪.
প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের রাজনৈতিক স্বরূপ আমরা জানি, কিন্তু বাবা হিসেবে কেমন ছিলেন তাজউদ্দীন? চলুন সেটাই দেখে আসা যাক তার মেজ কন্যার স্মৃতিচারণ থেকেঃ

১। আব্বু কারাগার থেকে মাসে একবার হলেও চিঠি লিখতেন। মনে আছে একবার আব্বুর চিঠির সাথে কোন এক খবরের কাগজের কাটা অংশ ছিল, সেখানে বিস্কিটের বিজ্ঞাপনে ছোট একটি মেয়ের ছবি। আব্বু পাশে লিখেছিলেন, 'রিমির মত দেখতে তাই ছবিটা কেটে রেখেছিলাম'। সেই ছোট্ট আমার সেদিন কত ভাল লেগেছিল।

২। ১৯শে আগষ্ট আমার জন্মদিনের তারিখ। '৬৮ সালের এই দিনটির তিন দিন পর আমরা আব্বুর সাথে দেখা করতে গেছি। ওয়েটিং রুমের মোটা লোহার গরাদ ধরে রিপি আর আমি দাঁড়িয়ে আছি। দেখি আব্বু আসছেন, হাতে টিনের কৌটায় ছোট একটি গাছ। ওয়েটিং রুমে ঢুকে আমার সামনে গাছটি নিয়ে বললেন, 'আমার রিমির জন্মদিনের জন্য এটা আব্বুর দেয়া উপহার'। এটি একটি ডালিম গাছ। আমি কত যে যত্ন করে সাবধানে গাছটিকে ঢাকায় নিয়ে এলাম!

৩। শরৎ রচনাবলীর নতুন আটটি খন্ড তখন বাজারে এসেছে। আমি আমার এক বন্ধুর কাছ থেকে তার একটি খন্ড নিয়ে এসেছিলাম পড়তে। কিন্তু সময়মত পড়ে আর শেষ করতে পারিনি। যে দিন বইটি ফিরিয়ে দেব সেদিন গাড়িতে বসেই তাড়াহুড়া করে পড়ছিলাম। আমি স্কুলে নেমে যাবার আগে আব্বু বললেনঃ কি বই এটা?

আমি বললামঃ শরৎ রচনাবলী।

আব্বু বললেনঃ এইভাবে বই পড়ে কি কিছু বোঝা যায়?

স্কুল ছুটির পর আমি মিমিকে জুনিয়র সেকশনে ডাকতে গিয়ে দেখি আমাদের ড্রাইভার সাহেব এদিকের গেটেই দাঁড়িয়ে আছেন। আমাকে দেখেই বললেনঃ তাড়াতাড়ি আসেন, সাহেব অনেকক্ষণ ধরে এই গরমে গাড়িতে বসে আছেন। তাড়াতাড়ি গিয়ে দেখি, আব্বু ঘেমে ভিজে গেছেন। মুখে স্বভাবসুলভ এক টুকরো হাসি, পাশে অনেকগুলা বই। শরৎ রচনাবলীর আটটি খন্ড। আমি বুঝতে পারছিলাম না কি করব। বোবার মত বাসায় ফিরেছি। খুশিতে কান্নায় বুক ফেটে যাচ্ছিল।

[ আমার ছোটবেলা ১৯৭১ এবং বাবা তাজউদ্দীন আহমদ ― সিমিন হোসেন রিমি ]


২৫.
তাঁর(তাজউদ্দীন আহমদ) সীমাবদ্ধতা বোধহয় একটা ছিলঃ তিনি হঠাৎ কখনও সারক্যাষ্টিক মন্তব্য করে ফেলতেন। যেমন, একটি ঘটনার উল্লেখ করতে পারি। একবার বাংলাদেশের কোন একটি অঞ্চল থেকে দলীয় কিছু লোকজন এসে তাজউদ্দীন সাহেবের সাহেবের সাথে দেখা করলেন। তাঁরা তাঁদের বিভিন্ন অভাব-অভিযোগের কথা বলে নানা রকম কিছু দাবী করছিলেন এবং বলছিলেন, সহায়-সম্পত্তি পরিবার-পরিজন সব তাঁরা দেশে ফেলে এসেছেন। তাজউদ্দীন সাহেব বলে ফেললেন, 'সব কিছু ফেলে এসেছেন সত্যি, কিন্তু স্বভাবটা তো ফেলে আসেননি, সাথে করে নিয়ে এসেছেন'। অবশ্য আমার মনে হয়, যে প্রচন্ড ধরনের চাপের মধ্যে তিনি থাকতেন এবং আমাদের কিছু মানুষের চরিত্র যে ধরনের তাতে তিনি কেন আমিও চটে যেতাম।

― এ. কে. খন্দকার

[ তাজউদ্দীন আহমদ ― আলোকের অনন্তধারা (প্রথম খন্ড) ]


২৬.
আমার বন্ধু সাভারের আনোয়ার জং তাজউদ্দীন আহমদের সাথে ১৫ই আগষ্টের পর জেলে এক রুমে ছিল। আনোয়ার জং আমাকে বলেছিল, তাজউদ্দীন আহমদ জেলখানায় দুঃখ করে বলেছেন, 'বঙ্গবন্ধুকে এইসব লোক হত্যা করল, কিন্তু তিনি কোনদিনই জানতে পারলেন না যে তাজউদ্দীন এর মধ্যে নেই। তাঁর প্ল্যাটফর্মের উপরে দাঁড়িয়ে আমাকেও হয়ত একসময় জীবনটা দিতে হবে। কিন্তু তিনি সেই জিনিসটা জেনে যেতে পারলেন না। নিয়তির কি নির্মম পরিহাস, বিশ্বাসঘাতকতা করল খন্দকার মোশতাক'

― আরহাম সিদ্দিকী

[ তাজউদ্দীন আহমদ ― আলোকের অনন্তধারা (প্রথম খন্ড) ]


২৭.
মুক্তিযুদ্ধের নয়টি মাস তিনি পরিবারের সাথে বসবাস করেননি। এমনকি ছেলের কঠিন অসুখের সময় বাসায় যেতে অনুরোধ করলে তিনি আমাকে বলেছিলেন, 'আপনারা যদি এইসব আলাপ করতে আসেন তাহলে তো দেশ স্বাধীন করে ফিরে যাওয়ার দরকার নাই। সোহেলকে নিয়েই আমি থাকি, আমার জন্য এইখানে একটা বাড়িঘর করে এখানেই থাকার ব্যবস্থা করেন। ভারত যদি আপনাদেরকে রাখার জন্য রাজী থাকে তাহলে সেই সংস্থান করে এখানেই থাকেন। সোহেলের মত তো কত ছেলে আমার চারদিকে। তাই এটা নিয়ে আমার সঙ্গে আলাদাভাবে আলাপ করার প্রয়োজন নাই।'

― আরহাম সিদ্দিকী

[ তাজউদ্দীন আহমদ ― আলোকের অনন্তধারা (প্রথম খন্ড) ]


২৮.
তাজউদ্দীন আহমদের সাথে শ্রীমতি গান্ধীর প্রথম আলোচনায় তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, 'এটা আমাদের যুদ্ধ। আমরা চাই ভারত এতে জড়াবে না। আমরা চাই না ভারত তার সৈন্য দিয়ে, অস্ত্র দিয়ে আমাদেরকে স্বাধীন করে দিক। এই স্বাধীনতার লড়াই আমাদের নিজেদের এবং আমরা এটা নিজেরাই করতে চাই। এই ক্ষেত্রে আমাদের যা দরকার হবে তা হচ্ছে, আমাদের মুক্তিবাহিনী গড়ে তুলবার জন্য আপনার দেশের আশ্রয়, ট্রেনিং এর সমস্ত রকম সুবিধা এবং সে ব্যাপারে আপনাদের সাহায্য-সহযোগিতা এবং অস্ত্র সরবরাহ'।

― আমীর-উল ইসলাম

[ তাজউদ্দীন আহমদ ― আলোকের অনন্তধারা (প্রথম খন্ড) ]


২৯.
'তাজউদ্দীন সাহেবের সাথে আমার পরিচয়টা খুব অল্প সময়ের। বলতে গেলে ১৯৭২ থেকে '৭৫ পর্যন্ত। এরই মধ্যে তাঁকে আমি দেখেছি একজন মানুষ কীভাবে শুধু মানুষের জন্যই চিন্তা করতে পারে এবং কিভাবে শুধু অন্যের ভালোটাই চাইতে পারে। দ্বিতীয়ত, তাঁর দেশপ্রেম। যা ছিল অতুলনীয়। দেশের উন্নতি, দেশের ভালোর জন্য তিনি নিজের মত পরিবর্তন করতে দ্বিধা করতেন না। তাঁকে আমি কোনদিনই হতাশ হতে দেখিনি। দেশ সম্পর্কে বলতে গিয়ে এক্সাইটেড হয়ে যেতেন। দেশ তাঁর কাছে ছিল প্রায় স্বপ্নের মত একটা কিছু। দেশটা সমৃদ্ধিশালী হবে, মানুষের সমান অধিকার থাকবে, সম্পদের সুষ্ঠু বন্টন হবে, রাষ্ট্র নাগরিকের কল্যাণের জন্য কাজ করবে, নাগরিকের কাজের ব্যাবস্থা করে দেবে। কিন্তু এর সবকিছুই হবে সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে যাতে করে উন্নয়নের সব দিকেই একটা ভারসাম্য রক্ষা করা যায়'

― আবুল মাল আব্দুল মুহিত

[ তাজউদ্দীন আহমদ ― আলোকের অনন্তধারা (প্রথম খন্ড) ]


৩০.
আমরা যখন কথাবার্তা বলছি সেই সময় আমি একটু উত্তেজিতই ছিলাম। আমি কথায় কথায় বলেই ফেললাম, 'বঙ্গবন্ধুর অবদানের চেয়ে আপনার অবদান তো কম নয়'।

আমার এই কথা শুনে তাজউদ্দীন সাহেব আমার উপর অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হলেন। বললেন, 'এ কথা কখনও বলবেন না। বঙ্গবন্ধুর অবদান আমার চেয়ে অনেক বেশী'। এ কথা বলতে পারি, শেষ পর্যন্ত আমিই বঙ্গবন্ধুর সাথে থাকব। বর্তমানে সাময়িক এক বিভ্রান্তি হতে পারে, কিন্তু এটা আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, বঙ্গবন্ধু না হলে দেশটা স্বাধীন হত না। আমরা এই স্বাধীনতার কাজে সহযোগিতা করেছি। বঙ্গবন্ধুর অবদান আর আমার অবদানের তুলনা করাটা আপনার ঠিক নয়, মতিউর রহমান'।

― মতিউর রহমান

[ তাজউদ্দীন আহমদ ― আলোকের অনন্তধারা (প্রথম খন্ড) ]


৩১.
পাকিস্তান আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষা করতে গিয়ে কার্যত সমগ্র আওয়ামী লীগ সংগঠন দেশের সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে গিয়ে আশ্রয় নেয়। আক্রমণের অভাবনীয় ভয়াবহতা, সর্বময় কর্তৃত্বের অধিকারী নেতার কারাবরণ, পরবর্তী কর্মপন্থা ও নেতৃত্ব সম্পর্কে অনিশ্চয়তা ইত্যাকার বাধাবিপত্তি সত্ত্বেও মূলত মধ্যবিত্ত নেতৃত্বে পরিচালিত আওয়ামী লীগ এক দূর্লভ বৈপ্লবিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার কাজে প্রয়াসী হয়। আওয়ামী লীগের এই প্রয়াসে অনেক নেতা এবং অগণিত কর্মীর অবদান ছিল। এদের মধ্যে মত ও পথের বিভিন্নতাও ছিল বিস্তর। তৎসত্ত্বেও সামগ্রিক বিচারে এই দল পরিণত হয় স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রধান রাজনৈতিক যন্ত্রে। এবং যন্ত্রের চালক হিসেবে একজনের ভূমিকা ছিল সন্দেহাতীতভাবে অনন্য। তিনি তাজউদ্দীন আহমদ।

তাজউদ্দীন ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, দুই দশকেরও অধিক কাল ধরে শেখ মুজিবের ঘনিষ্ঠ সহকর্মী, ১৯৬৪ সালে আওয়ামী লীগ পুনরুজ্জীবিত হবার পর থেকে সকল দলীয় নীতি ও কর্মসূচীর অন্যতম মূখ্য প্রণেতা, দলের সকল মূল কর্মকান্ডের নেপথ্য ও আত্মপ্রচার-বিমুখ সংগঠক। '৭১-এর মার্চে অসহযোগ আন্দোলনের সামগ্রিক পরিকল্পনা ও পরিচালনার ক্ষেত্রে মুজিবের পরেই ছিল সম্ভবত তাঁর স্থান।

[ মূলধারা '৭১ ― মঈদুল হাসান ]

৩২.
একদিন আব্বু নিজের জন্য একটি সাইকেল কিনে নিয়ে এলেন। আব্বু যে দিন প্রথম তাঁর সাইকেল নিয়ে কাউকে কিছু না বলে উধাও হয়ে গেলেন সে দিন আমার খুব মজাই লাগছিল। দেখি আব্বুর নিরাপত্তার জন্য নিয়োজিত অফিসার রীতিমত আতঙ্কিত― মন্ত্রী সাহেব গেলেন কোথায়? সন্ধ্যার অনেক পরে উৎফুল্ল আব্বু ফিরলেন। আব্বু কয়েকটা বাজারে ঘুরেছেন। একেবারেই সাধারণ মানুষ হিসেবে অনেকের সাথে কথা বলেছেন। আব্বু বলতেন, ছাত্রজীবনে তাঁর একটা সাইকেল ছিল। সেই সাইকেল চালিয়ে তিনি ঢাকার এ মাথা থেকে সে মাথা ঘুরতেন, দু'পাশের মানুষদের দেখতেন।

[ আমার ছোটবেলা ১৯৭১ এবং বাবা তাজউদ্দীন আহমদ ― সিমিন হোসেন রিমি ]


৩৩. তাজউদ্দীন আহমদ ভারতের সাথে কী চুক্তি করেছিলেন?
যখন ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে ইয়াহিয়া খান ভারতের উপর যুদ্ধ চাপিয়ে দিল এবং ভারতের সরাসরি যুদ্ধে জড়িত হওয়া ছাড়া উপায় নেই, সেই সময়ে তাজউদ্দীন সাহেব শ্রীমতি গান্ধিকে বললেন যে, বাংলাদেশে ভারতীয় সৈন্য ঢুকবার আগে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে হবে এবং কিভাবে সৈন্য ঢুকবে তার একটা ভিত্তি তৈরি করতে হবে। সেই ভিত্তি ছাড়া বাংলাদেশে ঢোকা যাবে না।

তাজউদ্দীন সাহেবের কত বড় দূরদর্শিতা, এবং তিনি কত বেশী সজাগ থাকলে এই কথা বলা সম্ভব, এটা ইতিহাস নিশ্চয়ই বিচার করবে। অথচ এটার জন্যই তাঁকে দোষারোপ করা হয় যে, তিনি নাকি ভারতের সাথে চুক্তি করেছিলেন। চুক্তি যদি বলা হয়, চুক্তি নিশ্চয় করেছেন, কিন্তু সেই চুক্তি ছিল যে, ভারত আমাদেরকে স্বীকৃতি দেবে, তারপরে ভারতের সৈন্য বাংলাদেশে ঢুকবে এবং যৌথ কমান্ডের মাধ্যমে ঢুকবে। যুদ্ধ পরিচালনার ব্যাপারে ভারতকে সবসময় আমাদের সাথে, আমাদের কমান্ডের সাথে একত্রিত থাকতে হবে। এবং যখনই বাংলাদেশ সরকার বলবে তখনই ভারতের সৈন্যদের বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যেতে হবে।

― আমীর-উল ইসলাম

[ তাজউদ্দীন আহমদ ― আলোকের অনন্তধারা (প্রথম খন্ড) ]


৩৪.
ছোটবেলায় দেখেছি, আমের মৌসুমে মা আমের মোরব্বা বানান। সব কাজের মেয়েরা এক হয়ে রুটি বেলার পিঁড়ির উপর আমের টুকরোটাকে কেঁচতো। মুক্তিযুদ্ধের সময় তাজউদ্দীন সাহেবের অবস্থা দেখে আমার সেই ঘটনাটাই মনে হয়েছে। প্রতি মূহুর্তেই তাজউদ্দীন সাহেবকে যেন সবাই কুপিয়েছে। কোন কাজই সুন্দরভাবে মসৃণভাবে হতে দেয়নি। মন্ত্রীরা বিভক্ত ছিল অনেকগুলো ভাগে। তাজউদ্দীন সাহেবকে অনেকগুলা বাধা অতিক্রম করতে হয়েছে, মাথা ঠান্ডা রাখতে হয়েছে। ধৈর্য, সহনশীলতার সাথে মূল লক্ষ্যপথে এগিয়ে গিয়েছেন তিনি। তাঁর একটাই উদ্দেশ্য বা লক্ষ্যঃ যুদ্ধে জয়লাভ করা, জয়ী হওয়া। দেশ থেকে যারা শরনার্থী এসেছে তাদের সাথে নিয়ে দেশে ফেরা। যারা পাক বাহিনী দ্বারা নির্যাতিত তাদের নির্যাতন থেকে মুক্ত করা। একটা স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ সৃষ্টি করা।

― মোহাম্মদ নূরুল কাদের

[ তাজউদ্দীন আহমদ ― আলোকের অনন্তধারা (প্রথম খন্ড) ]


৩৫. মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প তাজউদ্দীন আহমদ
তাজউদ্দীন সাহেবের পরিকল্পনা ছিল, অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ না করে এর পেছনে যে মানুষগুলো আছে তাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করা। যদি অস্ত্রের পেছনের লোকগুলো নিয়ন্ত্রণ করা যায় তাহলে অস্ত্র স্বাভাবিকভাবেই নিয়ন্ত্রণ হয়ে যাবে। সেজন্য তিনি দেশ মুক্ত হবার সাথে সাথে প্রতিটি জেলায় মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য পুনর্বাসন কেন্দ্র খুলেছিলেন। সেখানে তাদের অস্ত্রসহ তারা থাকবে, তাদেরকে ট্রেনিং দিয়ে উপযুক্ত করে গড়ে তোলা হবে। এরপর তারা নিজ নিজ পেশায় চলে যাবে। তাঁর প্রথম বিবেচনা ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ক্যাম্প করা। তাতে প্রত্যেকটি মুক্তিযোদ্ধা আমাদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে এবং নতুন স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশে প্রয়োজনে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের কাজে তাদের লাগানো যেত।

কিন্তু পরবর্তীতে এটি আর করা হল না। তাদেরকে সোজা বলা হল, তোমরা অস্ত্র জমা দিতে আসো। তাতে যেগুলো ভারি অস্ত্র, যেগুলো নিয়ে ঘুরে বেড়ানো যায় না, সেগুলো জমা হল, কিন্তু ছোট ছোট অস্ত্র রয়েই গেল। সেগুলো কোনদিনই উদ্ধার করা গেল না এবং এই ছেলেগুলোকে আমরা হারিয়ে ফেললাম। অথচ এরা ছিল মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে বড় ফসল।

― আমীর-উল ইসলাম

[ তাজউদ্দীন আহমদ ― আলোকের অনন্তধারা (প্রথম খন্ড) ]


৩৬. নীতির প্রশ্নে আপোষহীন তাজউদ্দীন আহমদ
বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি সৈয়দ হোসেন সাহেব সরকারী কর্মকর্তা ছিলেন। তিনি প্রেসিডেন্সী কলেজের ছাত্র এবং ভাল লেখাপড়া জানা লোক। তাঁর সাথে আমার ভাল একটা সম্পর্ক ছিল। তিনি তাজউদ্দীনকে অত্যন্ত সন্মান করতেন। আমাকে বলতেন, 'মন্ত্রী যতগুলো আছে সব শোনাউল্লাহ, শুনে শুনে কাজ করে। একমাত্র লোক হল তাজউদ্দীন সাহেব যে নিজে কাজ করে। তাজউদ্দীন সাহেব, শুনবে, বলবে, লিখে দেবে। তাঁকে সবাই ভয় করে। কারণ সে সাংঘাতিক নীতিবান মানুষ। নীতির বাইরে কোন কাজ সে করবে না।'

― ম. ওয়াহিদুজ্জামান

[ তাজউদ্দীন আহমদ ― আলোকের অনন্তধারা (প্রথম খন্ড) ]


৩৭.
১৯৬৯ সালে গোল টেবিল বৈঠকে যোগ দিতে যখন বঙ্গবন্ধু রাওয়ালপিন্ডি গেলেন তখন তাঁর সাথে অন্যান্যদের মধ্যে তাজউদ্দীন সাহেবও ছিলেন। সেখানে দেখলাম, তিনি খুব বড় মনের মানুষ, বঙ্গবন্ধুর খুব কাছের মানুষ তাজউদ্দীন সাহেব। আর শেখ সাহেবও সবসময় কথা প্রসঙ্গে রেফারেন্স দেন তাজউদ্দীন সাহেবের। আমার মনে হল, তিনি খুব সরল মানুষ। তাঁর চেহারার মধ্যে এক ধরনের সারল্য ছিল। তখন তো তিনি আওয়ামী লীগের জেনারেল সেক্রেটারি। তাঁর সাথে কথা বললে সেইরকম মনে হয়না। এই সাধারন ধরনের একজন। খুব আস্তে আস্তে কথা বলেন, বেশী কথা বলেন না। সাধারণত রাজনৈতিক নেতারা খুব বেশী কথা বলেন, শুনতে হয় বেশী। তাঁর কাছে গেলে তিনিই শোনেন বেশী।

― আবুল মাল আব্দুল মুহিত

[ তাজউদ্দীন আহমদ ― আলোকের অনন্তধারা (প্রথম খন্ড) ]


৩৮.
তাজউদ্দীন মন্ত্রীর পদ থেকে সরে যাবার পর আমি কয়েকবার তার বাসায় গিয়েছি। তাজউদ্দীন বলেছিল, 'খন্দকার মোশতাক বঙ্গবন্ধুকে মিথ্যা বলতে বলতে এমন পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছে যে এখন সে এও বলছে, তাজউদ্দীন আপনাকে ধাক্কা দিয়ে নিজে পদ দখল করতে চায়'।

সেই সময়ের রাজনৈতিক অবস্থান দেখে আমরা যারা রাজনীতির বাইরের মানুষ তারা সহজেই বুঝতাম, বঙ্গবন্ধু তাজউদ্দীনের প্রতি খুশী নন। অথচ এই দেশের জন্য বঙ্গবন্ধুর অবদান যেমন বিশাল তেমনি বাংলাদেশের জন্মের সময় মূল যে মানুষ তাজউদ্দীন, সেই তাকেই বাদ দিয়ে দেওয়া হল।

তাজউদ্দীনের স্মৃতি আমার জীবনের পবিত্র সঞ্চয়। মানুষ হিসেবে তাজউদ্দীন ছিল তুলনাহীন। সে রাজনীতি করত মানুষের জন্য। তার রাজনীতি ছিল অন্য সবার চাইতে আলাদা।

― ম. ওয়াহিদুজ্জামান

[ তাজউদ্দীন আহমদ ― আলোকের অনন্তধারা (প্রথম খন্ড) ]


৩৯. ধর্মনিরপেক্ষ তাজউদ্দীন
ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী তাজউদ্দীন ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারের তীব্র সমালোচনা করে বলেছেনঃ ধর্মের ওপর ভিত্তি করে দেশে কোনো রাজনৈতিক দল থাকবে না। অর্থনৈতিক ও গঠনমূলক কর্মসূচির উপর ভিত্তিশীল রাজনৈতিক দলগুলোকেই শুধু এখানে কাজ করার অনুমতি দেওয়া হবে। বাংলাদেশ হবে একটি সম্পূর্ণ ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। বাংলাদেশে প্রতিটি ধর্মের জন্য পূর্ণ স্বাধীনতা থাকবে। রাষ্ট্র কোনো ধর্মের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করবে না। ধর্মের নামে কাউকে শোষণ করতে দেওয়া হবে না। ধর্মীয় ভিত্তিতে কোনো সংখ্যালঘু সম্প্রদায় থাকবে না। দেশের সাধারণ নির্বাচনে পরাজিত দলই শুধু সংখ্যালঘু হিসেবে বিবেচিত হবে।

[ তাজউদ্দীন আহমদের স্বদেশভাবনা ― প্রফেসর আনিসুজ্জামান ]


৪০.
বাংলাদেশের নিরন্ন দুঃখী মানুষের জন্য রচিত হোক এক নতুন পৃথিবী, যেখানে মানুষ মানুষকে শোষণ করবে না। আমাদের প্রতিজ্ঞা হোক ক্ষুধা, রোগ, বেকারত্ব আর অজ্ঞানতার অভিশাপ থেকে মুক্তি। এই পবিত্র দায়িত্বে নিয়োজিত হোক সাড়ে সাত কোটি বীর বাঙ্গালী ভাইবোনের সম্মিলিত মনোবল ও অসীম শক্তি। যাঁরা আজ রক্ত দিয়ে উর্বর করছে বাংলাদেশের মাটি, যেখানে উৎকর্ষিত হচ্ছে স্বাধীন বাংলাদেশের নতুন মানুষ, তাঁদের রক্ত আর ঘামে ভেজা মাটি থেকে গড়ে উঠুক নতুন গণতান্ত্রিক সমাজব্যাবস্থা; গণ-মানুষের কল্যাণে সাম্য আর সুবিচারের ভিত্তিপ্রস্তরে লেখা হোক 'জয় বাংলা' 'জয় স্বাধীন বাংলাদেশ'।

― তাজউদ্দীন আহমদ(১৯৭১)

[ তাজউদ্দীন আহমদের আলোকভাবনা ]


৪১.
পিকিংপন্থি রাজনীতি, মুক্তিযুদ্ধ, অতঃপর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পিকিংপন্থি দলগুলোর মধ্যে কেবল মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন অংশটি বাদে অন্যরা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়। পিকিংপন্থি ১৪টি দল একটা সমন্বয় কমিটি গঠন করে। তারা মওলানা ভাসানীকে তাদের সঙ্গে আহ্বান করলে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করে মুজিবনগর সরকারের পাশেই অবস্থান করেন। এ অবস্থায় উক্ত সমন্বয় কমিটির নেতা মনোনীত হন দিনাজপুরের কমরেড বরদা চক্রবর্তী। তাদেরকেও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের সুযোগ দানের আবেদন নিয়ে তিনি হাজির হন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের কাছে। প্রধানমন্ত্রী তাদের আবেদনের প্রেক্ষিতে যা বলেন তা বেশ তাৎপর্যপূর্ণঃ

কমরেড বরদা চক্রবর্তীর নেতৃত্বে আলোচ্য কমিউনিস্ট সমন্বয় কমিটির পক্ষ থেকে এক প্রতিনিধি দল মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে একটি স্মারকলিপি দাখিল করে। দাবিগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল, স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশগ্রহণের অনুমতি দিতে হবে এবং চীনপন্থি কমিউনিস্ট ক্যাডারদের মস্কোপন্থিদের অনুরূপ ট্রেনিং এর ব্যবস্থা এবং অস্ত্র দিতে হবে। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ চমৎকার জবাব দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন যে, কোনো দল বা গোষ্ঠীর স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য কোনো রকম অনুমতির প্রয়োজন হয় না। কাদেরিয়া বাহিনী, হালিম বাহিনী, হেমায়েত বাহিনী, আফসার বাহিনীসহ যেসব বাহিনী এই মুহূর্তে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করছে তারা কোনো অনুমতির তোয়াক্কা করেনি। তাই যুদ্ধে অংশগ্রহণের ব্যাপারটা সম্পূর্ণভাবে আপনাদের নিজস্ব সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভরশীল। তিনি আরো বললেন, এর পরেই হচ্ছে ট্রেনিং ও অস্ত্র প্রদানের প্রশ্ন। দেখুন কমরেডরা, মার্কসিজম সম্পর্কে অস্ত্রই হচ্ছে মার্কসিস্ট গেরিলাদের অস্ত্র। সাচ্চা কমিউনিস্ট গেরিলারা শত্রুর অস্ত্র দখল করে মুক্তিযুদ্ধ করে থাকে। কিন্তু এখন দেখছি, দুনিয়ার ইতিহাসে এই প্রথমবারের মতো চীনপন্থি মার্কসিস্টরা অস্ত্রের জন্য মুজিবনগরের পেটিবুর্জোয়া সরকারের কাছে দরখাস্ত করেছে। এটা কেমন করে সম্ভব? আমি পেটিবুর্জোয়া আওয়ামী লীগ সরকারের এমন 'আহাম্মক প্রধানমন্ত্রী' নই যে, আপনাদের হাতে অস্ত্র তুলে দেব; আপনারা কিছুদিন পরে সেই অস্ত্র আমাদেরই বুকে চেপে ধরবেন। কেমন ঠিক কিনা! সত্য কথা বলতে কি, আপনাদের নিশ্চয়ই জানা আছে যে, আমাদের অস্ত্র কোথা থেকে সরবরাহ হচ্ছে? সে ক্ষেত্রে যেসব শর্ত রয়েছে তার এক নম্বরই হচ্ছে এসব অস্ত্র যেন আপনাদের হাতে না যায়। কেননা আপনাদের মাধ্যমে এসব অস্ত্র দিব্বি পশ্চিম বাংলা ও বিহারের নকশালদের হাতে চলে যাবে। আপনাদের মতবাদ সম্পর্কে আমি ওয়াকিবহাল রয়েছি। কেননা বাংলাদেশের যুদ্ধ সম্পর্কে আপনাদের থিসিসগুলো ইতোমধ্যেই আমি পড়ে দেখেছি।

[ তথ্যসূত্রঃ তাজউদ্দীন আহমদ নিজ ভূমে পরবাসি ― শুভ কিবরিয়া, কামাল হোসেন তাজউদ্দীন আহমদ বাংলাদেশের অভ্যুদয় এবং তারপর অঙ্কুর প্রকাশনী, ঢাকা, ২০০৮ ]


৪২.
তাজউদ্দীন সাহেব প্রচন্ড রকমের আশাবাদী মানুষ ছিলেন- যাকে বলে যায় রোবাস্ট অপটিমিজম্‌। আমরা যদি কখনও বলতাম, চারিদিকে হতাশা, দুরাশা― এই সমস্ত কোন কথা, তখন তিনি বলতেন, 'আপনারা বই পড়েন'। আমাকে বলতেন, 'চৌধুরী সাহেব, আপনি বসে বই পড়েন, ইতিহাস পড়েন। তখন বুঝবেন আমাদের মত এমন ভয়াবহ সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের পর দেশের অবস্থা কি হয় এবং অন্যান্য দেশে কি অবস্থা হয়েছিল। এই অবস্থা সাময়িক এবং আমরা নিশ্চয়ই এই অবস্থা থেকে বের হয়ে আসব। তবে সব কিছু নির্ভর করবে আমাদের উপর। আইন-শৃঙ্খলা পরস্থিতি এবং অন্যান্য বিষয়গুলো আমরা কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করব তার উপর'। তিনি সমস্ত বিষয়গুলো বুঝতেন, কিন্তু হতাশ হতেন না। সব সময় সাহসের কথা বলতেন।

― আবু সাইদ চৌধুরী

[ তাজউদ্দীন আহমদ ― আলোকের অনন্তধারা (প্রথম খন্ড) ]


৪৩.
তাজউদ্দীন সাহেব অত্যন্ত শিক্ষিত এবং পন্ডিত ব্যাক্তি ছিলেন। এটা হয়ত অনেকেই জানে না যে, তিনি সমস্ত কাজের ফাঁকে লেখাপড়ার জন্য সময় বের করে নিতেন। বিশ্বের চিন্তাধারা, ভাবনার সাথে নিজেকে ওয়াকেবহাল রাখার একটা প্রচেষ্টা তাঁর ছিল। সম্পূর্ণ প্রচারবিমুখ ছিলেন বলেই এটা কিন্তু প্রকাশ করতেন না। তাঁর সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতে গিয়ে আমরা ব্যাপারগুলোর সাথে পরিচিত হয়েছিলাম। মাঝে মাঝে বলতাম, 'স্যার, আপনি তো আসলে রাজনীতিবিদ না'। তিনি প্রতিক্রিয়া দেখাতেন না। খুব সাধারণভাবে বলতেন, 'আসলেই রাজনীতিটা ডিফারেন্ট গেম'।

― আবুল মাল আব্দুল মুহিত

[ তাজউদ্দীন আহমদ ― আলোকের অনন্তধারা (প্রথম খন্ড) ]


৪৪.
তাজউদ্দীন সহজে আদর্শবাদ থেকে বিচ্যুত হওয়া মানতে চাইতেন না। তিনি সাধারণভাবে বিশ্বাস করতেন যে, পরনির্ভরশীলতার মাধ্যমে যে উন্নতি সে উন্নতিকে আদৌ উন্নতি হিসেবে দেখা যাবে কিনা, এবং সেই উন্নতির জন্য বড় মূল্য দিত হবে কিনা। সাহায্য আমাদেরকে পরনির্ভরশীল করে রাখবে বা মাথা নত করে রাখবে এই চিন্তাটি তাজউদ্দীন আহমদ করতেন।

তাজউদ্দীনকে সোশ্যালিস্ট বলা যাবে না। তিনি মিশ্র অর্থনীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি বলতেন, আমরা সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রতি দায়বদ্ধ, অঙ্গীকারাবদ্ধ, সুতরাং সেই সমাজতন্ত্র করতে পারব না যেখানে ভোটারকে অগ্রাহ্য করা যায়। তিনি মানুষের সমতার কথা ভাবতেন। আবার এটাও পরিষ্কার বুঝতেন, সংসদীয় পদ্ধতিতে অর্থনৈতিক স্বার্থে একটি অংশ সমতা চাইতে পারে না।

― খান সারওয়ার মুরশিদ

[ তাজউদ্দীন আহমদ ― আলোকের অনন্তধারা (প্রথম খন্ড) ]


৪৫.
জুলাই মাসের লাস্টে তাজউদ্দীন সাহেবের কাছে একটা অথেনটিক রিপোর্ট আসল, আর্মি ইন্টেলিজেন্সের ভেতরে একটা খুব ডিপ রুটেড কন্সপাইরেসী ম্যাচিউরড হয়ে গেছে। এই খবরটা এসেছে। ওরা একদম কনফার্মড যে বঙ্গবন্ধুকে শেষ করে দেবে। ওরা হটিয়ে দেবে এই গভর্মেন্ট। দেশের একটা ভয়াবহ ক্রাইসিস।

এই খবর পেয়ে সেদিন রাত্রে ১১টায়, তাজউদ্দীন সাহেব গেঞ্জী আর লুঙ্গি পরে গেট খুলে বাইরের দিকে যাচ্ছেন। আমি বললাম, 'এত রাত্রে কোথায় যাচ্ছ?'। আমি উনার সঙ্গে সঙ্গে নীচে নেমেছি। উনি কিচ্ছু না বলে চলে গেলেন। বঙ্গবন্ধুর বাসায়। এইগুলো আমি পরে শুনেছি। মুজিব ভাই ঘুমানোর ব্যবস্থা করছিলেন। তাজউদ্দীন পরিষ্কারভাবে বললেন, 'মুজিব ভাই, আমি একটা কথা বলার জন্য এসেছি, আপনি খুব সিরিয়াসলি নেবেন। হাল্কাভাবে নেবেন না যে আমার দেশের মানুষ আমাকে ভালবাসে। আর্মি ইন্টেলিজেন্সের দিকে কালকেই নজর দেন। একটা গভীর কন্সপাইরেসী ম্যাচিউরড হয়ে এখনই টাইম ওদের জন্য'।

― জোহরা তাজউদ্দীন

[ 'তাজউদ্দীন আহমেদঃ নিঃসঙ্গ সারথি' ]


৪৬.
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি যে আঘাত হানার চেষ্টা করবে সে বিষয়ে তাজউদ্দীন আহমদ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালেই এক প্রকার নিশ্চিত হন। এ বিষয়ে তিনি জয় বাংলা পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী সম্পাদক আবদুল গাফফার চৌধুরীকে ১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসেই ইঙ্গিত প্রদান করেন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এ ধরনের চক্রান্তের বিষয়ে তাজউদ্দীন আহমদের অনুমান ও বিশ্লেষণ কতকটা নিষ্ঠুর ভবিষ্যদ্বাণীর মতো ছিল। আবদুল গাফফার চৌধুরীর ভাষ্যে এটি নিম্নরূপঃ

... প্রশ্ন করলাম: বিদেশি ষড়যন্ত্র সফল হবে বলে আপনি মনে করেন?তাজউদ্দীন বললেন: তৃতীয় বিশ্বে ফরেন এইড বা বিদেশি সাহায্য এবং তার রাজনৈতিক ভূমিকা সম্পর্কে মার্কিন লেখকদেরই কয়েকটি লেখা আমি পড়েছি। এই লেখা পড়ে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আমি শংকিত। এদের অপারেশন হবে অনেকটা এই ধরনের। বাংলাদেশ মুক্ত হলে এরা বিপুল সাহায্যের অফার নিয়ে এগিয়ে যাবে এবং নিজেদের তত্ত্বাবধানে সাহায্য বিতরণ করতে চাইবে। সাহায্য যা পাওয়া যাবে, তার বারো আনা ব্যয় হবে তাদের তদারকিতে, সাহায্য প্রেরণের জাহাজ ভাড়ায় এবং তাদের লোকদের খরচ মেটাতে। কিন্তু বাইরে প্রচার হবে, বাংলাদেশে সাহায্যের বন্যা বইয়ে দেয়া হয়েছে। এই সাহায্য প্রকৃত অভাবী লোকদের হাতে পৌঁছাবে না। সাহায্যের টাকার দৌলতে সরকারি প্রশাসনে তাদের সমর্থক শক্তিশালী গ্রুপ তৈরি করা হবে। দেশপ্রেমিক অফিসার ও মুক্তিবাহিনীর লোকজনকে দুর্নীতিপরায়ণ করার চেষ্টা হবে। সরকারবিরোধী এবং সংশ্লিষ্ট বিদেশিদের সমর্থক রাজনৈতিক দল ও পত্রিকাকে টাকা দেওয়া হবে। সরকারি দলের মধ্যে নিজেদের গ্রুপ তৈরি করা হবে। সামরিক বাহিনীর আনুগত্য ও দেশাত্মবোধ নষ্ট করা হবে। তারপর বাংলাদেশের নতুন সরকার যদি এই বিদেশিদের কথামত না চলেন, তাহলে সব দুর্নীতি ও খারাপ কাজের দায় দায়িত্ব সরকারের কাঁধে চাপানো হবে। সাধারণ মানুষ বিশেষ করে শ্রমিক শ্রেণীকে বিক্ষুব্ধ করে তোলা হবে। ব্যবসায়ী শ্রেণীকে হাত করে দেশে অর্থনৈতিক বিপর্যয় সৃষ্টি করা হবে এবং এইভাবে প্রতিষ্ঠিত সরকারের জনপ্রিয়তাকে নষ্ট করার পর সিভিল অথবা মিলিটারি ক্যু ঘটিয়ে পছন্দমত তাবেদার সরকার বসানো হবে।... বললেন, শেখ মুজিব দেশে ফিরে কি করতে চাইবেন আমি জানি না। যদি তিনি আমার কথা শোনেন, তাহলে এই বিপদ মোকাবিলা করা যাবে।

[ তাজউদ্দীন আহমদ নিজ ভূমে পরবাসি ― শুভ কিবরিয়া, আবদুল গাফফার চৌধুরী, ইতিহাসের রক্তপলাশ পনেরই আগস্ট পঁচাত্তর (ঢাকা : আগামী প্রকাশনী, ১৯৯৬) ]


৪৭. তাজউদ্দীন আহমদ বাকশাল প্রসঙ্গ -
তাজউদ্দীন সাহেবের ধারণা ছিল, পরিকল্পিত অর্থনীতি বাকশালের মধ্য দিয়ে সম্ভব, কিন্তু প্রিম্যাচিউর জিনিস দিয়ে কিছু করা যাবে না। মানুষ তো শিক্ষিত বা তৈরীই হয়নি ওই কাজের জন্য। সেই প্রস্তুতি বা শিক্ষাটাই যদি ভিত্তিতে না থাকে, তাহলে হঠাৎ করে কিছু করা যাবে না, চাপিয়ে দিয়ে কোন জিনিস হবে না, হতে পারে না। যেমন, মোহাম্মদ তুঘলক তামার নোট প্রচলন করেছিল। দ্যাট ওয়াজ টু আরলি, তামার নোট ওই সময়ে চলেনি। এটাই একই অবস্থা বলে আমি পরিষ্কার মনে করি।

তিনি বলতেন, যারা এটা করবে তারা যদি কঠোর রাজনৈতিক শৃঙ্খলায় বিশ্বাসী না হয় তবে এই পদ্ধতির ভুল ব্যবহার করবে। এর ফলে আপনি যা যা করবেন ব্যুরোক্রেটরা দেখিয়ে দেবে কোনটাই কৃতকার্য হয়নি। আর বর্তমান বাংলাদেশে আমরা যে অবস্থায় আছি এটা কিছুতেই সেই কাজের জন্য উপযুক্ত সময় নয়। আমাদের দেশে তো চতুর লোকের অভাব নেই, কাজেই যারা সমস্ত জীবন ত্যাগস্বীকার করেছে তাদেরকে পেছনে ঠেলে ওইসব লোক সামনে আসছে। এরা শুধু বাহবাই দেয় এবং এরাই সবচাইতে বেশী স্যাবোটাজ করে। এর মধ্যে টিকে থাকা যাবে কিনা আমার সন্দেহ আছে। আমরা কর্মীদেরকে আন্দোলন করা শিখিয়েছি, দেশ গড়ার কাজ কিভাবে করতে হবে তা শেখাইনি। তার মধ্যে সামনে চলে আসছে নতুন পদ্ধতি, কাজেই মনে একটা আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।

― আরহাম সিদ্দিকী

[ তাজউদ্দীন আহমদ ― আলোকের অনন্তধারা (প্রথম খন্ড) ]


৪৮. তাজউদ্দীন আহমদ বাকশাল প্রসঙ্গ -
এই ৩৭ দিনের বিদেশ সফর থেকে ফিরে আসার পর একদিন সকালে তাজউদ্দীন সাহেব অফিসে এসে বললেন, 'চৌধুরী সাহেব, আপনাকে সাক্ষী রেখে একটা কথা বলব'। আমি সাথে সাথে বললাম, 'স্যার, আমাকে সাক্ষী রেখে কি লাভ হবে আপনার?' আমি একজন সরকারী কর্মকর্তা, কাল আপনি ছেড়ে দিলে আমি অন্য জায়গায় চলে যাব। তাই আমাকে সাক্ষী রেখে আপনার কি লাভ? আপনি বরং আপনার বিশ্বস্ত রাজনৈতিক ব্যাক্তিত্ব কাউকে সাক্ষী রেখে কথা বলেন।' তাজউদ্দীন সাহেব বললেন, 'না, আপনি শুনবেন'।

এই কথা বলে তিনি বঙ্গবন্ধুকে লাল ফোনে টেলিফোন করলেন। বললেন, 'আপনার সাথে আমার কতকগুলো জরুরী বিষয়ে আলোচনা করা দরকার বলে আমি মনে করি। আপনার ওখানে আপনি লোকজন দিয়ে এত পরিবৃত থাকেন যে সেখানে বসে আপনার সাথে কথা বলার জন্য আমি লাল টেলিফোনটাই বেছে নিলাম। আপনি একদলীয় শাসনব্যবস্থা করতে যাচ্ছেন, কিন্তু আপনাকে আমি অনেকবারই বলেছি আমার দ্বিমতের কথা, আর আজ আমার চূড়ান্ত মতামত দিচ্ছি। আমি আপনার এই একদলীয় শাসনের সাথে একমত নই। আপনি আমাকে বলুন, কেন আপনাকে এই পথে যেতে হবে?' এটুকু বলে তাজউদ্দীন সাহেব থামলেন, তখন নিশ্চয়ই বঙ্গবন্ধু কিছু বললেন। এরপর তাজউদ্দীন সাহেব বললেন, 'এক নম্বর কথা, আমি আপনার যুক্তিতে কনভিন্সড্‌ না। দুই নম্বর কথা― এটা প্রশ্ন না, এটা আমার স্টেটমেন্ট ― বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আপনার হাতে এতই ক্ষমতা দেওয়া আছে যে সেই ক্ষমতাবলে দেশে একদলীয় ব্যবস্থা বা আর কোন পরিবর্তনে প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করিনা। আপনার হাতেই তো সব ক্ষমতা আছে, কাজেই একদলীয় ব্যবস্থার পক্ষে আপনি যা বলছেন আমার কাছে এর কোন যৌক্তিকতা নেই। তৃতীয় কথা, আমি আর আপনি বাংলাদেশ স্বাধীন হবার আগে ২৪-২৫টা বছর একসাথে বাংলাদেশের এমন কোন মাঠ-ময়দান নেই যেখানে যাইনি। আমরা বক্তৃতায় সবসময় বলেছি একটি সুখী সমৃদ্ধিশালী দেশের কথা, যার ভিত্তি হবে গণতন্ত্র। যে গণতন্ত্রের গুণগান করেছি আমরা সব সময়, আজকে আপনি একটি কলমের খোঁচায় সেই গণতন্ত্রকে শেষ করে দিয়ে দেশে একদলীয় শাসনব্যবস্থা করতে যাচ্ছেন। আপনার এই সিদ্ধান্তে আমি অত্যন্ত জোরের সাথে দ্বিমত পোষণ করছি।'

এরপর আরও দু-চারটি এমনই কথাবার্তা হল। সবশেষে তিনি যে কথাটি বললেন সেটি ছিল প্রফেটিক কথা। তিনি ইংরেজীতে বললেন, 'বাই টেকিং দিস স্টেপ ইউ আর ক্লোজিং অল দা ডোরস টু রিমুভ ইউ পিসফুলি ফ্রম ইওর পজিশান। এই কথাটি আমি আমার সমস্ত জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি। মানুষের কিন্তু গত্যন্তর থাকবে না। ভবিষ্যতে আপনাকে কেউ ক্ষমতা থেকে সরাতে চাইলে সেই সরাবার জন্য গণতান্ত্রিক কোন পথ আপনি খোলা রাখছেন না। তখন একটাই পথ খোলা থাকবে আপনাকে সরাবার- আর সেটা হচ্ছে বন্দুক।'

মনে হল বঙ্গবন্ধু ফোনের ঐ প্রান্তে রেগে গেছেন, তাঁর চিৎকারের শব্দ টেলিফোনের বাইরেও ভেসে আসছিল। তাজউদ্দীন সাহেব বললেন, 'কিন্তু মুজিব ভাই, সবচাইতে দূর্ভাগ্যজনক ঘটনা কী ঘটবে জানেন, আপনাকে এত নিষেধের পরেও আপনার সাথে ওই বন্দুকের গুলিতে আমরাও মারা যাব। আপনি তো শুধু মারা যাবেন না। দেশটারও ভয়ানক ক্ষতি হয়ে যাবে'।

― আবু সাইদ চৌধুরী

[ তাজউদ্দীন আহমদ ― আলোকের অনন্তধারা (প্রথম খন্ড) ]


৪৯. তাজউদ্দীন আহমদ বাকশাল প্রসঙ্গ -
এর কিছুদিন পরে তাজউদ্দীন সাহেবকে আমি বলেই ফেললাম, 'স্যার, এই অবস্থায় আপনি তো বলছেন আর আপনি থাকতে পারছেন না বা থাকতে চাইছেন না, তবে আপনি কেন বঙ্গবন্ধুকে বলছেন না যে আপনি থাকবেন না?' তিনি বললেন, 'চৌধুরী সাহেব, এই ব্যাপারে এইভাবে মুজিব ভাইকে বলায় আমার একটা অসুবিধা আছে, আপনারা সেটা জানেন না'। আমি বললাম, 'স্যার, কী অসুবিধা আমাকে বলেন'। তিনি বললেন, 'স্বাধীনতার আগের দীর্ঘ সময়ে হয়ত আমি তাঁর পাশে গেছি, নয়ত তিনি আমার পাশে এসেছেন। শুধুমাত্র যখন কারাগারে বন্দি থাকতাম তখন আমরা দু'জন বিচ্ছিন্ন থাকতাম। এই যে একটা গভীর সম্পর্ক এ থেকে তাঁর প্রতি আমার একটা বিশ্বস্ততা গড়ে উঠেছে। এখন তিনি যদি আমাকে চলে যেতে বলেন আমি বেরিয়ে যাব, কিন্তু তাঁকে আমি সরাসরি বলব এই বিষয়টি আমার যেন কেমন মনে হয়, যদিও আমি মনেপ্রাণে চাচ্ছি আমি থাকব না'।

― আবু সাইদ চৌধুরী

[ তাজউদ্দীন আহমদ ― আলোকের অনন্তধারা (প্রথম খন্ড) ]


৫০. তাজউদ্দীন আহমদ বাকশাল প্রসঙ্গ -
আমি তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, 'আপনি কেন বঙ্গবন্ধুকে বাকশাল সম্পর্কে কিছু বলেন না?' তখন তিনি বললেন, 'বঙ্গবন্ধু যেহেতু এটা করে ফেলেছেন, তাই এই মূহুর্তে আমি কিছু বলতে গেলে আমাকে ভুল বুঝবেন। আর যারা বঙ্গবন্ধুকে বুঝিয়েছে তাজউদ্দীন আপনার বিরুদ্ধে, তারা তখন আমার কথাকে প্রমাণ হিসেবে দেখিয়ে বলবে যে, এই দেখেন আপনাকে না করছে। তাই এই সময়ে চুপ থাকাটাই ভাল। মুজিব ভাই যদি আমার প্রয়োজন অনুভব করেন, যদি আমাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করেন, তখন আমি আমার ধারণার কথা বলব। আমি যা বিশ্বাস করি তাই সবসময় বলি। চাটুকারিতা অথবা মিথ্যা আমি বলি না, এটা মুজিব ভাই নিজে খুব ভাল করে জানেন। এখন তো সবকিছু একটা তুঙ্গে আছে। বাকশাল নিয়ে একটা হৈচৈ। তাই বাকশাল নিয়ে এই মূহুর্তে কিছু বলা যাবে না। তবে বাকশাল করার জন্য যে অবস্থার দরকার হয় সে অবস্থা এখন আমি সামনে দেখছি না। এবং এর ওপর অনস্লট হয়ত কোন না কোন সময় আসতে পারে। কারণ বর্তমান অবস্থায় এই পদ্ধতিটা অনেকেই পছন্দ করবে না।

― আরহাম সিদ্দিকী

[ তাজউদ্দীন আহমদ ― আলোকের অনন্তধারা (প্রথম খন্ড) ]


৫১. তাজউদ্দীন আহমদ বাকশাল প্রসঙ্গ -
আমার সাথে তাজউদ্দীন সাহেবের শেষ দেখা অগাস্টের ৪ অথবা ৫ তারিখ ১৯৭৫ - এর রাতে। তখন ঢাকায় গুজব, যারা তাজউদ্দীন সাহেবের সাথে দেখা করতে যায় তার একটা হিসাব রাখা হয়। আমি এটিকে তেমন গুরুত্ব দিলাম না। বন্ধু জিয়াউল হক ও আমি তাঁর সাথে দেখা করতে গেলাম। অনেক কথা হল। আমি বাকশাল পছন্দ করি না। এই ব্যাপারে আমার দৃষ্টিভঙ্গি আমি বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলাম, তাজউদ্দীন সাহেবকেও বললাম। তাঁর সাথে কথা বলে আমার কাছে একটা ব্যাপার সুস্পষ্ট হল যে, বঙ্গবন্ধুকে বাদ দিয়ে তাজউদ্দীন সাহেব বাংলাদেশকে চিন্তা করেন না। এ যেন ছিল বঙ্গবন্ধুর প্রতি তাঁর বিশ্বস্ততার চূড়ান্ত প্রকাশ। তিনি বললেন যে, 'দেখুন, মুজিব ভাই যদি বাকশাল করে ভুল করে থাকেন তাহলেও আমাকে এখানেই থাকতে হবে। আমার আর কোন পথের কথা আমি চিন্তা করি না, কেননা আমি সারাজীবন তাঁর সঙ্গেই ছিলাম। আমি এভাবে এ অবস্থায় তাঁকে ছেড়ে চলে যেতে পারি না। আমার কী বিশ্বাস, না বিশ্বাস সেটা অন্য বিষয়। কিন্তু এখানে আমার কোন বক্তব্য নেই। ঘটনা হচ্ছে, উনি যখন করেছেন আমাকে যোগ দিতেই হবে। তবে রাজনৈতিক অঙ্গন যখন অস্থির, মানুষের হতাশা বড় গভীর। মুজিব ভাই হয়ত খুব বড় ঝুঁকি নিয়েছেন। এতে তিনি নিজেও নিঃশেষ হয়ে যেতে পারেন, সাথে আমরাও মারা পড়ব'।

পরবর্তীতে আমরা স্মরণ করেছি কী প্রফেটিক উচ্চারণই না তিনি করেছিলেন!

― আবুল মাল আব্দুল মুহিত

[ তাজউদ্দীন আহমদ ― আলোকের অনন্তধারা (প্রথম খন্ড) ]


৫২.
'মুছে যাক আমার নাম, তবু বেঁচে থাক বাংলাদেশ'।

― তাজউদ্দীন আহমদ(১৯৭১)

৫৩.
'আসুন আমরা দেশের জন্য এমনভাবে কাজ করি যেন ভবিষ্যতে যখন ঐতিহাসিকেরা বাংলাদেশের ইতিহাস রচনা করবে তখন যেন আমাদের খুঁজে পেতে কষ্ট হয়'।

― তাজউদ্দীন আহমদ(১৯৭১)

৫৪.
Tajuddin Ahmed, 46. Prime Minister, a lawyer who has been a chief organizer in the Awami League since its founding in 1949. He is an expert in economics and is considered one of the party's leading intellectuals.

Monday, Dec. 20, 1971. TIME Magazine
Bangladesh: Out of War, a Nation Is Born

৫৫.
চীনা রাজনীতিতে চৌ-এর নীরব অথচ গঠনমূলক ভূমিকার মতোই বাংলাদেশের রাজনীতিতে তাজউদ্দীনের নীরব অথচ একটি ঐতিহাসিক গঠনমূলক ভূমিকা পালন করে গেছেন। এই ভূমিকা গ্রহণের ক্ষেত্রে অনেক ভুলভ্রান্তি এবং ত্রুটি ও বিচ্যুতি হয়ত তার ছিল। কিন্তু স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে তাঁর এই ভূমিকাটিকে সম্প্রসারণের ও শক্তি বৃদ্ধির সুযোগ দেওয়া হলে ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশের জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের এত বড় বিপর্যয় এত সহজে হয়ত ঘটত না।

তাজউদ্দীনকে পাকিস্তানিরা- বিশেষ করে জুলফিকার আলী ভুট্টো ও তার সহকর্মীরা কি ভয় করতেন তার একটা ঘটনা বলি। ১৯৭১ সালে মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠকের সেই রুদ্ধশ্বাস দিনগুলোর কথা। ভুট্টোও এসেছেন ঢাকায়। আছেন ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে। কড়া মিলিটারি পাহারা। আমরা ক’জন বাঙালি সাংবাদিক তার সঙ্গে সাক্ষাতের অনুমতি পেয়েছি। মুজিব-ইয়াহিয়া আলোচনার অগ্রগতি সম্পর্কে তিনি বেশি কিছু বলতে চাইলেন না। দুজন সহকর্মীর সঙ্গে তিনি উত্তেজিত কণ্ঠে আলাপ করছিলেন। একসময় আমাদের উপস্থিতি ভুলে গিয়ে উর্দুতে বলে উঠলেন : আলোচনা বৈঠকে মুজিবকে আমি ভয় পাই না। ইমোশনাল এপ্রোচে মুজিবকে কাবু করা যায়। কিন্তু তার পেছনে ফাইল-বগলে চুপচাপ যে ‘নটরিয়াস’ লোকটি বসে থাকে, তাকে কাবু করা শক্ত। দিস তাজউদ্দীন, আই টেল ইউ, উইল বি ইউর মেইন প্রবলেম। আমি তোমাদের বলছি এই তাজউদ্দীন হবে তোমাদের জন্য বড় সমস্যা। আমি সঙ্গে সঙ্গে কথাটা নোট বইয়ে টুকে নিলাম। কিন্তু তখন বুঝতে পারিনি, কথাটা একদিন কতবড় ঐতিহাসিক সত্য হয়ে দাঁড়াবে।

[ যুদ্ধদিনের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ― শুভ কিবরিয়া, আবদুল গাফফার চৌধুরী, ইতিহাসের রক্তপলাশ পনেরই আগস্ট পঁচাত্তর (ঢাকা : আগামী প্রকাশনী, ১৯৯৬) ]

৫৬.
তাজউদ্দীনকে ভুট্টো আরও এক কারণে ভয় করতেন। অপ্রাসঙ্গিক, তবু সে কাহিনী এখানে বলছি।

১৯৬৬ সালের কথা। বঙ্গবন্ধু তার ঐতিহাসিক ছ’দফা দাবি ঘোষণা করেছেন। দেশময় বিরাট চাঞ্চল্য। আইয়ুব খাঁ ঘোষণা করেছেন, তিনি অস্ত্রের ভাষায় শেখ মুজিবের দাবির জবাব দেবেন। (বলাবাহুল্য, আইয়ুবের এই অপূর্ণ বাসনাই ১৯৭১ সালে টিক্কা-ইয়াহিয়া এবং ১৯৭৫ সালে মুশতাক-ভুট্টো পূর্ণ করেছেন)। ভুট্টো তখন আইয়ুবের বিদেশমন্ত্রী। তিনি আইয়ুবকে বললেন : মুজিবকে জেলে না পুরে তার সঙ্গে আগে আমাকে রাজনৈতিক লড়াই করতে দিন। এই লড়াই হলো তিনি ছ'দফা দাবি নিয়ে মুজিবকে তর্কযুদ্ধে আহ্বান জানাবেন। মুজিব রাজি হলে ঢাকায় জনসভা ডাকা হবে। সেই সভায় তিনি মুজিবের সঙ্গে ছ’দফা নিয়ে তর্ক করবেন। প্রমাণ করে দেবেন ছ’দফা অত্যন্ত অন্যায় ও বাজে দাবি। জনসাধারণের সামনে এইভাবে তিনি মুজিবকে পরাস্ত ও ব্যর্থ করে দেবেন।

আইয়ুব সম্ভবত ভুট্টোর এই প্রস্তাবে প্রথমদিকে রাজি হয়েছিলেন না। তাই রাওয়ালপিন্ডিতে বসে ভুট্টো শেখ সাহেবকে তার সঙ্গে তর্কযুদ্ধে নামার আহ্বান জানালেন।

চারদিকে বিরাট চাঞ্চল্য দেখা দিল। সকলের মনে প্রশ্ন, শেখ সাহেব কি এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করবেন?

আমরা ইংরেজ নাইটদের মধ্যে মধ্যযুগে ডুয়েলের গল্প পড়েছি। বাংলাদেশেও দুই মোল্লার মধ্যে ধর্মীয় বিষয় নিয়ে ওয়াজের মাহফিলে 'বাহাস' হতে দেখেছি। কিন্তু দুইজন আধুনিক রাজনৈতিক নেতার মধ্যে রাজনৈতিক দাবি নিয়ে তর্কযুদ্ধ? এ সম্পূর্ণ নতুন। আমরা সাংবাদিকরা ছুটলাম শেখ সাহেবের ধানমণ্ডির বাসায়।

শেখ মুজিব বাইরে ইজি চেয়ারে বসে পাইপ টানছিলেন। আমাদের দেখে মৃদু হাসলেন। উত্তেজনায় তখন আমাদের রয়ে সয়ে কথা বলার সময় নেই। সরাসরি প্রশ্ন করলাম : মুজিব ভাই, আপনি কি ভুট্টোর চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করবেন?

বঙ্গবন্ধুর পাশে তাজউদ্দীনসহ আরও কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতা বসা ছিলেন। বঙ্গবন্ধু তাদের দিকে তাকিয়ে আবার হাসলেন। বললেন : আমার প্রশ্নের জবাব দেবে তাজউদ্দীন।

আমরা তাজউদ্দীনকে ঘিরে ধরলাম : কি খবর তাজউদ্দীন ভাই?

তাজউদ্দীন বললেন : আমি আজ বিকেলে আওয়ামী লীগ অফিসে একটা সাংবাদিক সভা ডেকেছি। সেখানে এ প্রশ্নের জবাব দেব।

বিকেলে আমরা ছুটলাম আওয়ামী লীগ অফিসে। তাজউদ্দীন ভাবলেশহীন মুখে বসে কাগজ পড়ছেন। কাগজ থেকে মুখ তুলেই বললেন : আপনারা সকলেই এসেছেন?

কে একজন বললেন : হ্যাঁ, সবাই উপস্থিত।

তাজউদ্দীন আওয়ামী লীগের প্রেস রিলিজের একটা করে কপি দিলেন সকলের হাতে। বললেন : শেখ মুজিব ভুট্টোর চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছেন। আমরা নিজেদের অজান্তে আনন্দ ধ্বনি করে উঠলাম।

এরপরের ঘটনা দ্রুত ও সংক্ষিপ্ত। করাচি, পিন্ডি ও ঢাকার কাগজে বিরাট খবর বেরুলো : শেখ মুজিব ভুট্টোর চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছেন। ঢাকার পল্টনের জনসভায় দুই নেতা মুখোমুখি তর্ক যুদ্ধে নামবেন।

জনসভার দিনক্ষণ ঠিক হলো। বিরাট দল নিয়ে ঢাকা এলেন ভুট্টো। সত্যি কথা বলতে কি, আমরা মনে মনে তখন একটু ভীত। পারবেন কি শেখ মুজিব ভুট্টোর সঙ্গে তর্কযুদ্ধে? শেখ মুজিব জনপ্রিয় জননেতা। কিন্তু ভুট্টোর মতো তিনি পণ্ডিত নন। ভুট্টোর মতো বাকচাতুরি তিনি জানেন না। তাছাড়া তার সঙ্গে বিরাট বিশেষজ্ঞ দল।

তাজউদ্দীনকে ফোন করলাম।

তিনি বললেন : উহু এখন আমাকে ডিস্টার্ব করবেন না। ভুট্টোর সঙ্গে তর্কযুদ্ধে মুজিব ভাই যেসব কথা বলবেন, আমি তার ফ্যাক্টস-ফিগার যোগাড় করতে ব্যস্ত।

মুজিব যে ভুট্টোর চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছেন এ কথা আনুষ্ঠানিকভাবে জানানোর জন্য ভুট্টোর কাছে গেলেন তাজউদ্দীন। তাজউদ্দীনের সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলেই ভুট্টো গম্ভীর হয়ে গেলেন। আমরা পরে কনভেনশন লীগের নেতাদের কাছে শুনেছি, তাজউদ্দীনের সঙ্গে আলাপের পর ভুট্টো মন্তব্য করেছেন, হি ইজ ভেরি থরো। শেখের যোগ্য লেফটেন্যান্ট আছে দেখছি।

পল্টনের জনসভায় যোগ দেয়ার জন্য দূর-দূরান্ত থেকে ঢাকায় লোক আসতে শুরু করল। ট্রাফিক কর্তৃপক্ষ ঘোষণা করলেন, ওইদিন ঢাকায় ট্রাফিক কন্ট্রোল করা দুরূহ হবে। সুতরাং গাড়িঘোড়া চলাচলের জন্য ডাইভার্সন রোডের ব্যবস্থা করা হলো।

সভা হবে বিকেলে। সকালেই বিনা মেঘে বজ্রপাত। দুপুরের মধ্যে বিদ্যুৎ বেগে খবর ছড়িয়ে পড়ল, সারা ঢাকায় কাউকে কিছু না জানিয়ে ভুট্টো বিনা ঘোষণায় ঢাকা ছেড়ে রাওয়ালপিন্ডি চলে গেছেন।

এই খবর নিয়ে ঢাকার কোনো কোনো কাগজ বিশেষ সংখ্যা বের করল। একটি কাগজ হেডিং দিল, ‘ভুট্টোর পলায়ন।’

তাজউদ্দীনকে ভুট্টো ক্ষমা করেননি। ক্ষমা করেনি পাকিস্তানিরা। ১৯৭১ সালে তাজউদ্দীন বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব গ্রহণ করার পর টিক্কা খানের প্রচার দফতর থেকে ঢাকায় একটি প্রচারপত্র বিলি করা হয়। তাতে বলা হয় 'তাজউদ্দীন আসলে ভারতীয় ব্রাহ্মণ। মুসলমান নাম গ্রহণ করে তিনি আওয়ামী লীগে ঢুকছেন পূর্ব পাকিস্তানে ভারতীয় চক্রান্ত সফল করার জন্য।'

এই মিথ্যা প্রচার চালিয়ে তাজউদ্দীন সম্পর্কে বাংলাদেশের সরলপ্রাণ মুসলমানকে বিভ্রান্ত করতে চেয়েছিল সেদিনের পাকিস্তানি জঙ্গিশাহী। ১৯৭২ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও তাজউদ্দীন হয়েছেন প্রথম অপপ্রচারের শিকার। বলা হয়েছে, তিনি ভারতের সঙ্গে গোপন সামরিক চুক্তি করেছেন।

মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দিয়ে, রাজনীতি থেকে সরে গিয়েও তাজউদ্দীন বাঁচলেন না। ১৯৭৫ সালে তাকে তাঁর বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে জেলে ঢুকিয়ে বিনা বিচারে নির্মমভাবে হত্যা করা হলো। হত্যা করার পর রটানো হলো, তিনি জেলে বসে ভারতীয় হাই কমিশনারের কাছে গোপনে চিঠি পাঠিয়েছিলেন বাংলাদেশে ভারতীয় সৈন্য আনার জন্য। এই চিঠিটাও আবার বেনামা।

বঙ্গবন্ধু থেকে শুরু করে তাজউদ্দীনকে হত্যা যে বাংলাদেশের জাতীয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব ধ্বংস করার প্রথম সফল চক্রান্ত, এ কথা উপলব্ধি করার মতো সময় এখনো সকল বাঙালির হয়নি। একদিন এই উপলব্ধি সকলেরই হবে। কিন্তু সেদিন বড় বেশি দেরি হয়ে যাবে।

[ যুদ্ধদিনের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ― শুভ কিবরিয়া, আবদুল গাফফার চৌধুরী, ইতিহাসের রক্তপলাশ পনেরই আগস্ট পঁচাত্তর (ঢাকা : আগামী প্রকাশনী, ১৯৯৬) ]


অরিন্দম গুস্তাভো বিশ্বাস
০৩ নভেম্বর ২০১৩
ঢাকা