'নৌকা ছাড়ল আন্ধারিয়া গ্রাম
থেকে। বিয়ে করে শ্যামাকে নিয়ে সুকুমার রওয়ানা দিয়েছে দুপুরের দিকে। শ্যামা দেখতে পেল
আন্ধারিয়ার মাটি, গাছ, ঘরবাড়ি একটু একটু করে দূরে সরে যাচ্ছে। যেমন করে আন্ধারিয়ার
বাঁশঝাড়ের ওই পারে অন্ধকার নামলে একটু একটু করে অদৃশ্য হয়ে যায় নদীর ওইপারের গ্রাম,
আর কখনো কারো হাতে লণ্ঠন জ্বলে উঠলে নদীর পানিতে ভাসতে থাকা আলো জানান দেয় অদৃশ্য হলেই
সব নাই হয়ে যায় না।'— পড়লাম এবারের একুশে
বইমেলায় প্রকাশিত মোশাহিদা সুলতানা ঋতু'র প্রথম উপন্যাস 'লবণপানি'।
খুলনা জেলার উপকূলীয় অঞ্চলের
মানুষদের জীবনযাত্রা এই উপন্যাসটির মূল উপজীব্য বিষয়। বইটির সন্মন্ধে বলতে গেলে প্রথমেই
যেটার কথা বলতে হয় সেটা হল এটির প্রচ্ছদ। প্রচ্ছদশিল্পী শিবু কুমার শীলের ডিজাইনকৃত
দারুণ প্রচ্ছদটিতে সাইফুল হল অমির যে আলোকচিত্রটি ব্যবহৃত হয়েছে সেটা যেন উপন্যাসে
বর্নিত উদ্দাম ভদ্রা নদীর কথাই আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়। ওপারে দৃশ্যমান গাছপালা-গ্রাম
যেন দাঁড়িয়ে থাকে সংগ্রামী মানুষের বহু বছরের প্রান্তিক জীবনগাঁথাকে ধারণ করে।
যে গ্রামটিকে কেন্দ্র করে
এ উপন্যাস জীবন পেয়েছে তার নাম সুন্দরপুর। মূল ভূখন্ডের সাথে এক খেয়া পারাপার ছাড়া
এ গ্রামের সাথে আর কোন যোগাযোগ ব্যবস্থা নেই। গ্রামভর্তি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বিভিন্ন
মালিকানার চিংড়ি ঘের, যদিও এই মালিকেরা বেশীরভাগই থাকেন শহরে। এছাড়া এ গ্রামে রয়েছে
ছোট-বড় কৃষক, যারা চাষবাস করে জীবিকা অর্জন করে। বাগদা চিংড়িতে লাভের অংশ বেশী হওয়ায়
ঘের মালিকেরা সেটা চাষেই বেশী আগ্রহী। কিন্তু সেজন্য চাই লবণপানি, সেক্ষেত্রে ক্ষতির
সন্মুখীন হয় ছোট কৃষকেরা। কারণ মাটির সেই লবণাক্ততার জন্য কোন ফসলই আর ফলতে চায় না।
তাই তাদের দাবী চিংড়ি ব্যবসায়ীরা যেন মিষ্টি পানিতে গলদা চাষ করেন। কিন্তু অধিক মুনাফা
করার সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যাবে বলে সে প্রস্তাবে স্বভাবতই ঘের মালিকেরা রাজী নন। বিস্তৃত
পটভূমিতে বিভিন্ন চরিত্র, তাদের মধ্যকার সম্পর্ক, প্রেম-ভালবাসা, হিংসা-লালসা ইত্যাদি
আশ্রয় করে এ উপন্যাসের রক্ত-মাংস গঠিত হলেও এটার মূল কাঠামো গড়ে উঠেছে মিষ্টিপানি এবং
লবণপানি এই দুই পক্ষের অনিবার্য সংঘাতকে কেন্দ্র করে।
উপন্যাসের বেশ ক'টি চরিত্র
গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। জামাল চরিত্রটির গঠন খুবই শক্তিশালী, ঠিক যেন তাঁরই পেশীবহুল
শরীরের মত। আপাতদৃষ্টিতে নির্বিকার হলেও সে যে সমস্ত কিছু ভেঙে ফেলার ক্ষমতা রাখে সেটা
প্রমাণিত। সে ভয়ংকরভাবে অপরিণামদর্শী একটি চরিত্র হলেও সমাজে পরিবর্তন আনয়নে এমন মানুষ
দরকার পড়ে বৈকি! শ্যামা চরিত্রটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ হলেও কেন যেন মনে হয়েছে সে যথেষ্ট
বিকশিত নয়, শুধুমাত্র উপন্যাসের একটি বাঁক তৈরিতে অথবা একটি নির্দিষ্ট অবস্থা সৃষ্টিতে
ভূমিকা রেখেই সে হারিয়ে গেছে। অবশ্য এমন চরিত্রের নিয়তি এমনটা হওয়াই অবশ্যম্ভাবী হয়ত।
কল্পনা এবং বিকাশের চরিত্র দু'টি বৃহৎ উপন্যাসের একটি ছোট্ট অংশ হয়েও যেন আলাদা একটি
বিরহের গল্প হয়ে উঠেছে। এগুলো ছাড়াও বিশ্বজিৎ মেম্বরের চরিত্রটি সাধারণ মানুষের আস্থার
জায়গা হয়ে নজর কেড়েছে, হয়ে উঠেছে গ্রামীণ মানুষের কণ্ঠস্বর। ঘেরমালিক মান্নান সিকদার
চরিত্রটি শাসক শ্রেণীর প্রতিভূ, যারা নিজের স্বার্থ হাসিলে যে কোন কিছু করতেই রাজী।
পাগলাটে পরিমল চরিত্রটি উপন্যাসের শুরুতে সাধারণ মনে হলেও শেষ পর্যন্ত চরম মূল্য দেওয়া
নির্যাতিত মানুষের প্রতীক হয়ে উঠেছে।
গোটা উপন্যাসজুড়ে আঞ্চলিক
সংলাপের ব্যবহার দারুণ এক আবহ সৃষ্টি করেছে। নতুন বউ বরণের আবহমান সংস্কৃতি, উপকূলীয়
গ্রামের গভীর কাদাভর্তি নদীর ঘাটের পাশে চায়ের দোকান, অথবা সাধারণ মানুষদের উপর দমন-পীড়ন
চালানোর জন্য ক্ষমতাবান মানুষদের পেশীশক্তির ব্যবহার— এই ধরণের বিষয়গুলো যেন চিরন্তন
বলে মনে হয়।
লেখিকার বর্ণনা সুন্দর, কিছু
কিছু জায়গায় দারুণ মুগ্ধ হয়েছি। আর সে ক্ষমতার সাথে তুলনা করেই মাঝে মাঝে অনুভব করেছি
যে বেশ কিছু স্থানে বর্ণনাগুলো আরেকটু সুপাঠ্য ও সাবলীল হতে পারত। এছাড়াও আমার মনে
হয়েছে যে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বর্ণনার ক্ষেত্রে লেখিকা একটু দ্রুতপায়ে হেঁটেছেন। সেটার
ফলে একটা বিষয় ভিজ্যুয়ালাইজ করে ধারণ করতে যে নূন্যতম সময় প্রয়োজন, সেটা পাঠকের প্রয়োজন
অনুসারে পাওয়া যায়নি। অবশ্য এ বিষয়টি পাঠকভেদে ভিন্নও হতে পারে। তবে গোটা উপন্যাসটি
উপভোগ্য এবং উপকূলীয় মানুষের জীবন সম্পর্কে যাদের অভিজ্ঞতা সীমিত তাদের সে বিষয়ে একটি
সম্যক ধারণা দিতে সক্ষম। লেখিকা যে বর্ণনাগুলো তাঁর নিজস্ব সরেজমিন অভিজ্ঞতা থেকে লিখেছেন
এমন আভাস স্পষ্ট।
শোষক ও শোষিতের মধ্যকার দ্বন্দ্বের
যে আপাত সমাপ্তি লেখিকা টেনেছেন সেটা সামাজিক তথা রাজনৈতিক চিন্তাকে বেশ নাড়া দেয়।
দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া নির্যাতিত মানুষগুলো যে একসময় প্রতিবাদী হয়ে ঘুরে দাঁড়ায় সেটা
জামালের চরিত্রের মাধ্যমে আমরা দেখি। কিন্তু সেই রাতে পরিমলের রক্তাক্ত মাথা কিংবা
শ্যামার সহজ-সরল চেহারাটা মনে পড়লেও জামাল কিন্তু সেইসব ঘটনার জন্য সরাসরি দায়ী মানুষদের
আঘাত করে না, সে আঘাত হানে সেইসব পরিকল্পনার পেছনের মূল কুশীলবকে। বিষবৃক্ষের শাখা-প্রশাখা
না কেটে মূল উপড়ে ফেলার জন্য হাত বাড়ায়, ঠিক যেন সেই শক্তিশালী ঝড়ের মত। তাই বইয়ের
ফ্ল্যাপের ছোট্ট লেখাটার শেষ কথাটিই যেন অনুভবে ফিরে আসে— 'জীবন শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক'।।
অরিন্দম গুস্তাভো বিশ্বাস
২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৪
ঢাকা
লবণপানি
মোশাহিদা সুলতানা ঋতু
প্রকাশকঃ আগামী প্রকাশনী
প্রচ্ছদঃ শিবু কুমার শীল