পৃষ্ঠাসমূহ

১৩ মার্চ, ২০১৪

প্রিয় মৃত্তিকা

দেশের প্রতি ভালবাসাকে এক কথায় আমরা বলি 'দেশপ্রেম।' সংজ্ঞা ও প্রকাশে বিভিন্নতা থাকলেও এ শব্দের রয়েছে অনন্য এক বৈশিষ্ট্য। দেশপ্রেম নিয়ে কথা উঠলে কেউ কোনদিন প্রশ্ন করবেনা যে ঠিক কোন দেশের প্রতি প্রেমের কথা বলা হচ্ছে, কারণ দেশপ্রেমের 'দেশ' এক জন্মভূমি ছাড়া অন্য কোন দেশ হতেই পারে না। আমরা যেখানেই যাই না কেন, দিনশেষে জন্মভূমিই আমাদের আশ্রয়, সেখানেই প্রোথিত আমাদের পরিচয়।



'আর্থরাইজ' নামে একটি বিখ্যাত ফটোগ্রাফ আছে। জীবন্ত মানুষকে প্রথমবারের মত চাঁদের কক্ষপথে নিয়ে যাওয়া অভিযান এ্যাপেলো-৮ এর মহাকাশচারী উইলিয়াম অ্যান্ডার্স ছবিটি তোলেন ১৯৬৮ সালের ২৪শে ডিসেম্বর। খোলা প্রান্তরে চাঁদকে যেমন উঠতে দেখা যায়, তেমনি এই ছবিতেও দেখা যায় চাঁদের বিস্তৃত রুক্ষ প্রান্তরের দিগন্তরেখায় মহাকাশের অনন্ত অন্ধকার থেকে উঠে আসছে গাঢ় নীল রঙের পৃথিবী, আমাদের আজন্ম বাসস্থান। পৃথিবীর সেই অদেখা রূপ সেদিন মুগ্ধ করেছিল এ্যাপেলো-৮ এর সকল মহাকাশচারীদের।



আমরা সবাই এই পৃথিবীতে জন্ম নেই, একটা গোটা জীবন কাটিয়ে এই পৃথিবীতেই একদিন মৃত্যুবরণ করি। বসবাসের দারুণ অভ্যস্ততায় এক সময় এর সৌন্দর্য উপভোগের দৃষ্টিও আমরা হারিয়ে ফেলি। তবে নীলচে এই গ্রহটির পরিধি অতিক্রমের অবসরে এর অপার সৌন্দর্য দর্শনের সুযোগ যখন আমাদের ঘটে, তখন আমাদের হৃদয়ে জন্ম নেয় অপত্য এক ভালবাসা। দেশপ্রেমকেও এই একই ছকে ফেলা যায়। দেশকে আমরা সবাই ভালবাসি, তবে তার গভীরতায় আমরা তখনই আন্দোলিত হই যখন তা প্রমানসিদ্ধতার সুনির্ধারিত বাঁধাকে ছাড়িয়ে যায়। আর তাই মাঝে মাঝে দেশের বাইরে গিয়েও দূরত্বটাকে অনুভব করা প্রয়োজন।


ছাত্রজীবনে বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে যখন ব্যাঙ্গালোর থেকে দেশে ফিরতাম, তখন অদ্ভুত এক অনুভূতি টের পেতাম নিজের মধ্যে। ট্রেন হাওড়া স্টেশনে পৌঁছানোর আগে অনেক দূর থেকেই হাওড়া ব্রিজ দেখা যেত, সেটা দেখতে পাওয়া মানেই কলকাতা পৌঁছে গেছি। আমার কলকাতার বাঙ্গালি বন্ধুরা সেটা দেখার অধীর আগ্রহে ট্রেনের দরজায় গলা বাড়িতে রাখতো। ওদের সঙ্গে আমিও যোগ দিতাম, কিন্তু কোথায় যেন একটু খামতি থেকেই যেত, যশোর রোড পাড়ি দেওয়া যে তখনও বাকী! এরপর বেনাপোল বর্ডারে পৌঁছে অপেক্ষার প্রহর যেন আরও দীর্ঘ হতে শুরু করত। নো-ম্যানস-ল্যান্ডে প্রবেশ করার আগেই দেখতে পেতাম ওপাশে বাবা দাঁড়িয়ে আছেন আমার অপেক্ষায়। লোহার গরাদের সীমান্তরেখা পার হয়ে বাংলাদেশে ঢোকার মূহূর্তটা প্রতিবারই এক দারুণ আবেগী মুহূর্তে রূপ নিত। নিজ মাটিতে ফিরে আসার, আপন বাতাসে শ্বাস নেওয়ার যে কি অপার্থিব আনন্দ সে বুঝি এমন মূহূর্তেই শুধু অনুভব করা যায়, এমন অপার স্নেহ বুঝি কেবল মাতৃভূমির কোলেই খুঁজে পাওয়া যায়।

আমাদের চাওয়ার সঙ্গে পাওয়ার হিসেবটা ঠিকঠাক মেলেনা বলে ছোট্ট এই দেশটির প্রতি আমাদের অভাব-অভিযোগেরও কমতি নেই; সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেগুলোও আমাদেরই অতিক্রম করতে হবে, আর দেশকে ভালো না বেসে তা কখনই সম্ভব নয়। মোহমুগ্ধ মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের সমস্ত স্বপ্ন-সাধনাও কিন্তু ছিল পাশ্চাত্য সাহিত্যকে ঘিরে, তবে মোহনিদ্রা সাঙ্গ হবার পর বাংলা সাহিত্যকে তিনি ভরিয়ে দিয়ে গেছেন অকৃপণ হাতে। আর নিজের মতই মোহাবিষ্ট মানুষদের প্রশ্ন করে গেছেন অবিরাম―

নিজ গৃহে ধন তব, তবে কি কারণে
ভিখারী তুমি হে আজি, কহ ধন-পতি?
কেন নিরানন্দ তুমি আনন্দ সদনে?

একইভাবে তাঁর 'কিন্তু এ স্নেহের তৃষ্ণা মেটে কার জলে' এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আমাদের সেই জন্মভূমির কাছেই ফিরে আসতে হয়। প্রিয় এই জন্মভূমির জন্য নিরন্তর শুভকামনা। আমাদের সকলের অকৃত্রিম ভালবাসায় প্রিয় মৃত্তিকা ক্রমাগত এগিয়ে যাক শিখর জয়ের অভিযানে। সকল বাঁধার পাহাড় পেরিয়ে পৃথিবীর বুকে লাল-সবুজ আরও উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়ে উঠুক।।


অরিন্দম গুস্তাভো বিশ্বাস
সম্পাদনাঃ নুসরাত সুলতানা শিমু
০২-০৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৪
ঢাকা