পৃষ্ঠাসমূহ

২১ মে, ২০১৫

নতুন চলচ্চিত্র নতুন নির্মাতা - এপ্রিল ২০১৫

নামটা দেখেই প্রথম ভাল লেগেছিল— 'নতুন চলচ্চিত্র নতুন নির্মাতা'। জেনেছিলাম ফেসবুকের মাধ্যমেই। পড়েশুনে বুঝলাম যে ম্যুভিয়ানা ফিল্ম সোসাইটি এবং বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর যৌথ উদ্যোগে নতুন নির্মাতাদের সিনেমা নিয়ে আয়োজিত একটি বছরব্যাপী প্রতিযোগীতা এটি। প্রতিযোগীতায় স্বল্পদৈর্ঘ্য, পূর্ণদৈর্ঘ্য এবং প্রামাণ্যচিত্র— এই তিনটি বিভাগ রয়েছে। আরও জানলাম প্রতিযোগীতার প্রথম প্রদর্শনীটি অনুষ্ঠিত হবে শনিবার ২রা মে ২০১৫ বিকাল ৪টায়, শিল্পকলা একাডেমীর চিত্রশালা অডিটোরিয়ামে। মনে হল এই আয়োজনটি নতুন নির্মাতাদের যোগ্যতা প্রমাণের একটি ভাল প্ল্যাটফর্ম হতে পারে। তাই আমি প্রদর্শনীটি দেখতে যাবার সিদ্ধান্ত নিলাম।

ঢাকা শহরের প্রায় অন্য প্রান্ত থেকে চিরাচরিত জ্যাম ঠেলে গন্তব্যে পৌঁছতে আমার প্রায় পৌনে একঘন্টা দেরী হয়ে গেল। এরপর ঝুম বৃষ্টিতে আধভেজা হয়ে দুদকের সামনের শিল্পকলার গেট বন্ধ পেয়ে গেলাম পরের গেটে। সেটাও বন্ধ এবং বোঝা গেল মৎস্যভবনের দিকের গেটটি ছাড়া অন্য কোন গেট খোলা নেই। এদিকে তখনও গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ে চলেছে। এই গেটে একজন ক্ষমতাশালী ভদ্রমহিলা দাঁড়িয়ে ছিলেন এবং ওনার উপর্যুপরি ধমকে দারোয়ান গেট খুলে দিলে তাঁর সাথে আমিও প্রবেশ করতে পারলাম। জাতীয় চিত্রশালা ভবনের পাঁচ তলার অডিটোরিয়ামের সামনে আমি যখন পৌঁছলাম তখন ঘড়ির কাঁটা প্রায় পাঁচটা ছুঁই ছুঁই। নীরব অডিটোরিয়াম দেখে আমি ভেবে নিলাম প্রদর্শনী বুঝি শেষ। কিন্তু দেখা গেল যে প্রদর্শনী তখনও শুরুই হয়নি। যাহোক, আরও একটি ব্যপারে আমি ভুল প্রমাণিত হলাম। আমার ধারণা ছিল প্রদর্শনীটি উন্মুক্ত। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল যে নূন্যতম দর্শনী মূল্য ৩০ টাকা। আমি পরে জেনেছি যে প্রদর্শনী শেষে এই দর্শনী মূল্য নির্মাতারা পাবেন। আয়োজকদের এই সিদ্ধান্তটিও আমার ভাল লেগেছে।

ভীষণ ক্লান্তিকর এবং দীর্ঘ একটি ভূমিকা লিখে ফেললাম। এবার সিনেমার প্রসঙ্গে আসি। এদিনের প্রদর্শনীতে ছিল ৫টি শর্টফিল্ম এবং একটি ফুল-লেন্থ সিনেমা। সময়ের অভাবে আমি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রটি দেখতে পারিনি। থাকতে পারিনি উদ্বোধনী অনুষ্ঠানেও।

সিনেমার আলোচনায় যাওয়ার আগে আরেকটি কথা বলে নিতে চাই। কোন সিনেমা একবার দেখে সেটার সমালোচনা করতে যাওয়াটা ধৃষ্টতাসম। তাই আমার আলোচনায় ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকাটা স্বাভাবিক, আমার বোধগম্যতার অক্ষমতাকেও সদয় দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইল সবার প্রতি।


সিনেমাঃ আবিরের ঘর
নির্মাতাঃ সন্দিপ বিশ্বাস

আবিরের ঘর এখন তালাবদ্ধ থাকে। কিন্তু কেন? আবীর কোথায়? এই প্রশ্নের উত্তর আমরা জানতে শুরু করি যখন আবিরের মা তালা খুলে প্রবেশ করেন আবিরের ঘরে। বাংলাদেশে নিয়মিত ঘটে যাওয়া সড়ক দূর্ঘটনা, তার প্রতিকারের প্রচেষ্টাহীনতার ফলাফলের একটি ছোট্ট গল্প আমরা দেখতে পারি আবিরের ঘর সিনেমায়। শেষ দৃশ্যে আবিরের মা ঘর থেকে বের হয়ে যান, দর্শকরা থেকে যায় ঘরের ভেতর। জাগতিক ঘর না হলেও সেটা একটা চিন্তার ঘর তো বটেই।

সিনেমাটির নির্মান বেশ ভাল। আবিরের মায়ের কষ্টটা এমনিতেই দর্শকের কাছে মূর্ত হয়ে উঠেছিল, তাই বারবার দীর্ঘশ্বাস ছাড়ার ব্যপারটা একটু বাহুল্য বলে মনে হয়েছে।


সিনেমাঃ স্বপ্নের শিখরে হলুদ কোলাজ
নির্মাতাঃ মোরশেদ হিমাদ্রী হিমু

এই সিনেমার পটভূমি একটি উপকূলীয় অঞ্চল। মূল চরিত্র একটি পিতৃহীন ছেলে। তার বাবা সাগরে মাছ ধরতে গিয়ে আর ফিরে আসেনি। ঘরে আছে শুধু সৎ মা যে তাকে মোটেই পছন্দ করে না। এই সৎ মা'র সাথে সম্পর্ক আছে এক পয়সাওয়ালা লোকের। সবাই তাই এই ছেলেটিকেই পথের কাঁটা বলে মনে করে। এমন একটি পরিস্থিতিতে এই একাকী ছেলেটিকে নিয়ে সিনেমার গল্প। সাগরপারের মানুষের জীবনযাত্রার একটি চিত্রও উঠে এসেছে ভিজ্যুয়ালে।

আমার নজর কেড়েছে সিনেমাটির সিনেমাটোগ্রাফী। উপকূলীয় অঞ্চলের বিস্তৃত ল্যান্ডস্কেপ শটগুলো দারুণ প্রশংসার দাবীদার। প্রয়োজনীয় ডেপথ এবং কম্পোজিশন মিলিয়ে কিছু শট আমার খুবই ভাল লেগেছে। প্রায় প্রত্যেক অভিনেতা-অভিনেত্রীর অভিনয় ছিল বেশ উন্নত। তবে কিছু সংলাপে সম্ভবত আঞ্চলিক এবং সাধারণ বাংলাভাষায় কিছুটা মিশ্রণ হয়ে গিয়েছে।

এই সিনেমার সাথে 'স্বপ্নের শিখরে হলুদ কোলাজ' নামটির সার্থকতা আমার কাছে ঠিক পরিষ্কার নয়। স্বপ্নটা কী? এখানে বেঁচে থাকাটা বা টিকে থাকাটাই ছেলেটির স্বপ্ন বলে আমার মনে হয়েছে। আর হলুদ যদি অসুস্থতার রঙ ধরি তাহলে কি পরিচালক অসুস্থ সময়ে বা সমাজের অসঙ্গতির বিপরীতে ছেলেটির বেঁচে থাকার গল্প বলতে চেয়েছেন? তবে এক্ষেত্রে 'শিখর' ব্যপারটি অনালোকিত থেকে যাচ্ছে।

মূল চরিত্রের পোষাক নিয়ে কিছু কথা বলতে চাই। উপকূলীয় অঞ্চলের ল্যান্ডস্কেপগুলো অনেকটা সাদাটে বা ধূসর। এর মাঝে মূল চরিত্রটিকে উজ্জ্বল কমলা রঙের টি-শার্ট না পরালে হয়ত চোখের আরেকটু আরাম পাওয়া যেত। আবার এমনও হতে পারে যে নির্মাতা ইচ্ছাকৃতভাবে চোখে লাগানোর জন্য এটা করেছেন। তবে ছেলেটির পোষাক নিয়ে আমার আপত্তি আছে। সৎ মা'র সংসারে নিগৃহীত পিতৃহীন একটি ছেলে অবশ্যই প্রায় নতুন টি-শার্ট এবং থ্রী-কোয়ার্টার জিন্স পরে ঘুরবে না এবং তাঁর চুল এমন শৌখিনভাবে ছাঁটানো থাকা অসম্ভব।


সিনেমাঃ The Magic Remote
নির্মাতাঃ খন্দকার মো. জাকির

পাগল বা ছিটগ্রস্থ লোকদের আমরা বাইরে থেকে দেখে বুঝি যে কিছু একটা অস্বাভাবিকতা আছে। কিন্তু সেই পাগলের কাছে কিন্তু নিজের সব কর্মকান্ডই স্বাভাবিক। এমনই একজনের অস্বাভাবিক কাজকর্মের স্বাভাবিকতার প্রমাণ পাওয়া যাবে এই সিনেমাটিকে। নির্মাতা সিনেমাটিকে দেখিয়েছেন একজন পাগলের দৃষ্টিকোণ থেকে।

মূল চরিত্রে রূপদানকারী অভিনেতার অভিনয় এবং বিশেষ করে এক্সপ্রেশনগুলো বেশ ভাল ছিল। ছোট্ট এবং উপভোগ্য একটি নির্বাক সিনেমা। তবে শেষে এসে আমার আনন্দের সুতো কেটে গিয়েছিল। চার্লি চ্যাপলিনের বিখ্যাত সিনেমা 'মডার্ন টাইমস' এর আবহসঙ্গীতটি এখানে ব্যবহার না করলে ভালো হত। যারা চ্যাপলিনের সিনেমা দেখেননি তাদের সমস্যা নেই, কিন্তু যারা দেখেছেন তাদের জন্য এটা রিলেট করা কঠিন। আমি নিজের কথা বলতে পারি, এই মিউজিকটি শুরু হওয়ার সাথে সাথেই ভিজ্যুয়াল থেকে আমি বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছি, তখন আমার সামনে শুধুই চ্যাপলিন, ঘরভর্তি মানুষের মাঝখানে অদ্ভুত ভঙ্গিতে নেচে চলেছেন।


সিনেমাঃ প্রেক্ষাপট
নির্মাতাঃ আহমেদ সালেকীন

আমি এই সিনেমাটিকে একটি রাজনৈতিক সিনেমা বলতে চাই। আমাদের আশেপাশের বাস্তবতার নিরিখে এই সিনেমাটি একটি দারুণ সাহসী নির্মাণ। কোথায় যেন পড়েছিলাম যে শিল্পে সত্যের চর্চা যতই নিয়ন্ত্রিত হয়, সেখানে রূপকের ব্যবহার ততই গভীরতর হয়ে উঠতে থাকে। এই সিনেমাটিও রূপক নির্ভর কিন্তু এর শক্তিশালী ভিজ্যুয়ালের কারণে রূপকের অর্থ বুঝে নিতে দর্শককে কোন আলাদা শ্রম দিতে হয় না। ভাল শট এবং দক্ষ এডিটিং-এর ফলে সিনেমাটি পুরোটা সময় জুড়ে দর্শকের আগ্রহ ধরে রাখতে পেরেছে। নামমাত্র প্রপস্ এবং একটিমাত্র লোকেশন ব্যবহার করে এমন সিনেমা নির্মাণ পরিচালকের দক্ষতারই পরিচয় দেয়।

সিনেমাটি সম্পর্কে আরেকটি তথ্য জানিয়ে দেয়ার দরকার আছে বলে মনে করি। যে অভিনেতাকে পর্দায় বারবার নিগৃহীত হতে দেখবেন উনিই আসলে এই সিনেমাটির পরিচালক। এহেন নিপীড়ন সহ্য করতে অন্য কোন অভিনেতা রাজী না হওয়ার কারণে কিনা জানিনা, তিনি নিজেই গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রটিতে অভিনয় করেছেন। একারণেও তিনি বাহবা পেতে পারেন।

সিনেমার একদম শেষে পরিচালক যেন কিছুটা চোখে আঙুল দিয়েই রূপকের মানেটা দর্শকের কাছে পরিষ্কার করে দিতে চেয়েছেন। গোটা সিনেমার এই একটি জায়গাকেই আমার স্থূল কাজ বলে মনে হয়েছে। এমন দারুণ ভিজ্যুয়ালের পর এটার কোন প্রয়োজন ছিল না। আর তারপরেও যদি কেউ বুঝতে ব্যর্থ হতেন, তাহলে তার দায় পরিচালকের নয়, একান্তই সেই দর্শকের দূর্বল বোধগম্যতার।


সিনেমাঃ ফাঁদ
নির্মাতাঃ হুমায়ুন কবীর শুভ

এটি থ্রীলার ঘরানার একটি সিনেমা। লেটনাইট অফিসফেরতা এক যুবকের জনশূন্য বিল্ডিংয়ের লিফটে আটকে পড়া নিয়েই এগিয়েছে সিনেমাটির গল্প। এই বিপদের সময় মোবাইলের ব্যাটারী থেকে শুরু করে অসুস্থতা সবাই যেন তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যায়। এই অবস্থা থেকে মুক্তি মিলবে কি মিলবে না, অথবা কী ঘটবে যুবকের ভাগ্যে— এমন সব প্রশ্নের উত্তর পেতেই দর্শক মুখিয়ে থাকেন শেষ অব্দি। কিন্তু শেষ মানেই শেষ নয়, চূড়ান্ত উত্তর পাবার জন্য দর্শককে অপেক্ষা করতে হয় ক্রেডিট স্ক্রল শেষ হওয়া পর্যন্ত।

অন্ধকার লিফটের ভেতর শটগুলো প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য। এই ধরণের অল্প আলোতে কাজ করতে উন্নত কারিগরী জ্ঞানের প্রয়োজন হয়। শটগুলো দেখে আমার মনে পড়ে গিয়েছিল 'ব্যারিড' নামের একটি হলিউডি মুভির কথা।

সিনেমাটি দেখলেই এর নির্মাণের ফিটফাট ভাবটা চোখে পড়ে সবার আগে। তবে হৃদয়ে প্রবেশের যে কথাটি সিনেমার ব্যপারে বলা হয় সেখানে কিছুটা খামতি বোধহয় আছে। আবার এমনও হতে পারে যে থ্রীলার দেখে দেখে ভোঁতা হয়ে যাওয়া আমার অনুভূতিতে এর মাধুর্য ধরা পড়েনি। সেক্ষেত্রে ব্যর্থতার দায় আমারই।


সিনেমাঃ বৈষম্য
নির্মাতাঃ এ্যাডাম দৌলা

এটি ছিল এদিনের একমাত্র পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র। কিন্তু সময় স্বল্পতার কারণে আমি এটা দেখতে পারিনি।








প্রতিমাসেই নতুন চলচ্চিত্র জমা নেওয়া হচ্ছে ও প্রদর্শনী চলছে। আপনি যদি হয়ে থাকেন নির্মাতা অথবা দর্শক— চোখ রাখতে পারেন তাদের ফেসবুক পেজেঃ নতুন চলচ্চিত্র, নতুন নির্মাতা।।


অরিন্দম গুস্তাভো বিশ্বাস
১১ মে ২০১৫ এবং ২০, ২১ মে ২০১৫
ঢাকা