সাবজেকটিভ ক্যামেরায় মাটির
মাইটের ভেতর
থেকে দূর্গার
বিড়াল বের
করা, অথবা
দোলনায় দুলতে
থাকা উচ্ছল
চারুলতার POV শট। এক ট্রলি
শটে বিরাট
বিয়ের অনুষ্ঠান
অথবা পালকির
সাথে চলতে
শুরু করা
ট্রলির ঘুমন্ত
অপুতে এসে
থেমে যাওয়া। অথবা...
অথবা...
গুরু, তুমি যা
করে দেখিয়েছো,
সেটা মুখে
বলতে গেলেও
হাজারটা মুখের
দরকার হবে। তাই
সেই চেষ্টা
আর করলাম
না।
কুরোসাওয়া'র কথাটাই আরেকবার বলে
যাইঃ সত্যজিৎ
রায়ের সিনেমা
যে দেখেনি,
সে পৃথিবীতে
বাস করেও
চাঁদ আর
সূর্য দেখেনি।
১৯৯২ সালে সত্যজিতের অনারারি
অস্কারের উদ্ধৃতিতে লেখা হয়েছিল, 'চলচ্চিত্র নির্মাণে তাঁর বিরল প্রতিভা এবং গভীর মানবিক
দৃষ্টিভঙ্গীর স্বীকৃতিস্বরূপ, যেটা সারা বিশ্বের চলচ্চিত্র নির্মাতা এবং দর্শকদের স্থায়ীভাবে
প্রভাবিত করেছে।'
আজ (২রা মে
২০১৩) সত্যজিৎ
রায়ের জন্মদিন। তাঁর
সম্পর্কে বিভিন্ন
বিখ্যাত ব্যক্তিদের
অনুভূতি অনুবাদ
করে দিলাম।
আকিরা কুরোসাওয়া, চলচ্চিত্র পরিচালক
শান্ত কিন্তু গভীর পর্যবেক্ষণ
এবং অনুধাবন, মানবজাতির ভালবাসা, এইসবই হচ্ছে তার চলচ্চিত্রগুলোর চরিত্র, যেগুলো আমাকে
দারুণভাবে মুগ্ধ করেছে। ... আমার মনে হয়, তিনি চলচ্চিত্র শিল্পের একজন মহীরুহসম।
... তাঁর সিনেমা যে দেখেনি, সে
পৃথিবীতে বাস
করেও চাঁদ
আর সূর্য
দেখেনি।
পথের পাঁচালী দেখার পর আমার
মনের অনুভূতি আমি কখনও ভুলতে পারি না। এটি এমন ধরণের একটি সিনেমা যেটা প্রশান্তি এবং
আভিজাত্য নিয়ে বয়ে চলা বিরাট এক নদীর মত।
মানুষের জন্ম হয়, তারা জীবন
কাটায়, এবং একসময় মৃত্যুবরণ করে। কোন জবরদস্তি বা ঝাঁকুনি ছাড়াই রায় তাঁর সিনেমা নির্মাণ
করেন, কিন্তু দর্শকেরা আক্রান্ত হন গভীর ভাবাবেগে। এটা তিনি কিভাবে করতে পারেন? তাঁর
চলচ্চিত্র নির্মাণে অপ্রাসঙ্গিক বা এলোমেলো কিছু থাকেনা, এটাই হচ্ছে তাঁর উৎকর্ষতার
মূলমন্ত্র।
অর্মত্য সেন, নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ
সত্যজিৎ রায়ের কাজগুলো থেকে
বিভিন্ন সংস্কৃতির মধ্যকার একটি অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন বোধগম্যতা পাওয়া যায় এবং তাঁর
ধারণাগুলি বৈশ্বিক সাংস্কৃতিক বিতর্কের সাথে প্রাসঙ্গিক, ভারতীয় গন্ডিতে আবদ্ধ নয়।
দারিয়ূস কুপার, চলচ্চিত্র সমালোচক
একের পর এক চলচ্চিত্রে তিনি
ভারতের বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠানকর্তৃক সৃষ্ট শক্তি কাঠামো অথবা এর বিপরীতটির বিশ্লেষণ
করেন। খুবই বাস্তবসন্মতভাবে তিনি বিভিন্ন সমসাময়িক দ্বন্দ্ব ও বিষয়সমূহ বের করে আনেন,
তাঁর নিজের বঙ্গভূমির এবং বৃহৎ ভারতীয় জাতির।
এলিয়া কাজান, চলচ্চিত্র পরিচালক
সত্যজিৎ রায়কে অনারারি লাইফটাইম
এ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড দেওয়ার প্রশ্নে স্করসেসি এবং মার্চেন্টের সাথে আমিও একইসুরে
গলা মিলাতে চাই। বহুবছর ধরে আমি তাঁর সিনেমার প্রশংসা করেছি এবং আমার কাছে তিনি হলেন
ভারতীয় চলচ্চিত্রের কন্ঠস্বর, যিনি দেশের সকল শ্রেণীর মানুষের কথা বলেন... তিনি হলেন
সবচেয়ে সংবেদনশীল এবং উচ্চকন্ঠ শিল্পী এবং সত্যিকারভাবে এটাই বলা যায় যে তাঁকে সন্মানিত
করতে পেরে আমরা নিজেদেরকেই সন্মানিত করতে পারব।
জর্জ লুকাস, চলচ্চিত্র পরিচালক/চিত্রনাট্যকার, ১৯৯১
সত্যজিৎ রায় হলেন একজন অসাধারণ
চলচ্চিত্রনির্মাতা যিনি একটি লম্বা সময় ধরে বিস্তারিতভাবে কাজ করেছেন এবং সারা বিশ্বের
চলচ্চিত্রনির্মাতা এবং দর্শকদের উপরে যার গভীর প্রভাব রয়েছে। সত্যজিৎ রায়কে সন্মান
দেখানোর মাধ্যমে, একাডেমী তাঁর কাজগুলোকে আরও বেশী দর্শকের সামনে নিয়ে আসতে সাহায্য
করবে, বিশেষ করে নবীন নির্মাতাদের সামনে, যাদের উপরে তাঁর কাজ একটি ইতিবাচক ভূমিকা
রাখবে।
জেমস আইভরি, চলচ্চিত্র পরিচালক, ১৯৯১
সত্যজিৎ রায় হলেন শ্রেষ্ঠতম
পরিচালকদের একজন, জীবিত কিংবা মৃত। এটা কি কৌতুহলোদ্দীপক নয় যে সবচেয়ে নতুন এবং আধুনিকতম
শিল্পটি, তার গভীরতম এবং সাবলীল অভিব্যক্তি খুঁজে পেয়েছে সত্যজিৎ এর মত একজন শিল্পীর
কাজের মাঝে, যাকে তাঁর সিনেমাগুলো তৈরি করতে হয়, যার মধ্যে অনেকগুলোই মাস্টারপিস, পৃথিবীর
পুরাতনতম সংস্কৃতির একটি বিশৃঙ্খল ও পরিবর্তনশীল প্রান্তে বসে, যেখানে আজকের দিনের
আধুনিক চলচ্চিত্র-নির্মান সামগ্রী এবং যন্ত্রপাতির সবচেয়ে কঠোর ঘাটতি বিদ্যমান।...
যে মানুষটি সারা বিশ্বের চলচ্চিত্র নির্মাতাদের প্রভাবিত করেছেন, আমাদের উচিত তাকে
সন্মান প্রদর্শন করা, এবং ১৯৯২ এর বসন্তে তাঁকে লাইফটাইম অ্যাওয়ার্ড দিয়ে স্যালুট করা।
জন স্লেচেসিঙ্গার, চলচ্চিত্র পরিচালক/প্রযোজক/লেখক, ১৯৯১
...সত্যজিৎ এর অসাধারণ কাজগুলি
চলচ্চিত্রনির্মাতাদের শুধু দারুণভাবে প্রভাবিতই করেনি, তাঁদের মানবিক ধারণাকেও গভীরভাবে
প্রভাবিত করেছে। তাঁর চলচ্চিত্রে যে সরলতা প্রতিভাত হয় সেটাই একজন মহান স্রষ্টার পরিচয়
বহন করে এবং আমি খুবই খুশী হব যদি অ্যাকাডেমি তাকে সন্মানিত করে।
মার্টিন স্করসেসি, চলচ্চিত্র পরিচালক, ১৯৯১
সত্যজিৎ এর যাদু, তাঁর ইমেজগুলোর
সরল কাব্য এবং তাদের আবেগময় প্রভাব আমার সাথে সবসময় থাকবে।
আমি আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ
করছি, এবং সাথে সাথে অ্যাকাডেমির বোর্ড অফ ডিরেক্টর-দেরও, একজন মাস্টার মেকার, সত্যজিৎ
রায়... যিনি কিছুটা অসুস্থ থাকা সত্ত্বেও গত কয়েক বছরে তাঁর গভীর মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিকে
আবর্তন করে আরও দুইটি চলচ্চিত্র নির্মান করেছেন। চলচ্চিত্রে সত্যজিৎ এর কাজ তাঁর সমসাময়িক
ইঙ্গমার বার্গম্যান, আকিরা কুরোসাওয়া এবং ফেদেরিকো ফেলিনি-র সমপর্যায়ের।
২০০২
আমি তখন হাই স্কুলে পড়ি এবং
একদিন হঠাৎ করেই টিভিতে পথের পাঁচালী দেখি। ইংরেজীতে ডাব করা। কমার্শিয়াল সহ। এটা কোনই
সমস্যা করতে পারেনি, একটুও নয়। ভারতীয় সংস্কৃতি সম্পর্কে যে ধারণা আমাদের তখন ছিল,
এবং তখন আমার বয়স চৌদ্দ কি পনেরো বছর, সাধারণভাবে আমরা উপনিবেশবাদী(কলোনিয়াল) চোখ দিয়েই
সেটা দেখতাম। কিন্তু সত্যজিৎ রায় যখন তাঁর সিনেমা করেন তখন হঠাৎ করে সেই সংস্কৃতিটাকে
বোঝা যায় না কারণ সেটা যথেষ্ট জটিল, কিন্তু আস্তে আস্তে সেই সংস্কৃতির সাথে যোগসূত্র
স্থাপিত হয় মানুষগুলোর মাধ্যমে, এবং তারা কোন ভাষায় কথা বলছে, কি কাপড় পরে আছে, তাদের
রীতিনীতি কেমন এইসব কোন বাধা বলে মনেই হয়না। তাদের সামাজিক রীতিনীতিগুলো ছিল খুবই আকর্ষণীয়
এবং অবাক করার মত, এবং হঠাৎ করেই এই বোধগম্যতা নিজের মধ্যে আসতে শুরু করে যে বিশ্বে
আরও অনেক সংস্কৃতি রয়েছে।
পলিন কেল, চলচ্চিত্র সমালোচক
রেঁনোয়া এবং ডি সিকার মত,
সত্যজিৎ জীবনটাকে সুন্দর হিসেবে দেখেন বাস্তবে সেটা যত খারাপই হোক না কেন। যে শিল্প
হচ্ছে জীবনের কথন, মাতাল হওয়া ভয় না করে এই শিল্প আলোচনা করাটা কষ্টসাধ্য। কিন্তু অন্য
কোন ধরণের শিল্প আছে কি? সত্যজিৎ বলেন, 'সিনেমাতে ক্যামেরার জন্য সবকিছু নির্বাচন করতে
হবে অবশ্যই ভাব প্রকাশের ক্ষমতা অনুযায়ী'।
সত্যজিৎ এর চলচ্চিত্র(আমাদের
মত পাশ্চাত্যবাসীর জন্য, হয়ত প্রাচ্যের জন্যও কি?) কিছুটা বিরক্তিকর, কিন্তু চলচ্চিত্র
ও নাটকের বাইরে কোন প্রধান শিল্পী তেমনটি নন? তিনি আমাদের যা দিতে চান সেটা খুবই উচ্চস্বরের,
প্রকাশে এতই চিন্তাশীল(এবং আমরা এই ধরণের চলচ্চিত্রে পুরোপুরি অনভ্যস্ত, হয়ত তথ্যচিত্র
বাদে), যে আমরা ক্লান্তিকর মূহুর্তের মনোযোগ ভ্রষ্টতা খুঁজে বের করতে শুরু করি এবং
একই ধরণের চিত্তবিনোদন, আস্থা এবং স্নেহ অনুভব করতে থাকি যেটা আমরা অনুভব করি দারুণ
কোন উপন্যাস বা মহাকাব্যিক কবিতার বিরক্তিকর কোন স্কেচ দেখার সময়।
রবার্ট স্টিল, চলচ্চিত্র সমালোচক
আমি যখন পথের পাঁচালী দেখি...
আমি অবাক হয়েছিলাম। এটা ছিল একটা ভারতীয় চলচ্চিত্র যেটা ছিল একটা চলচ্চিত্র অথবা এটা
আমার চলচ্চিত্রের ধারণার সাথে মিলে গিয়েছিল এবং এটা ছিল তার মধ্যে অন্যতম একটি। ভারতে
নির্মিত আমার দেখা এটা প্রথম চলচ্চিত্র যেটা আমাকে লজ্জিত এবং বিরক্ত করেনি।
রবিন উড, চলচ্চিত্র সমালোচক
আমরা(পশ্চিমা দর্শকেরা) কি
জোর গলায় বলতে পারি যে আমরা আমাদের সংস্কৃতির থেকে ভিন্ন সংস্কৃতির কোন কাজ বুদ্ধিমত্তা
এবং আবেগ দিয়ে বুঝতে সক্ষম?
... এইটা খুবই অসাধারণ যে
সত্যজিৎ এর চলচ্চিত্রে সাংস্কৃতিক পার্থক্য থেকে উদ্ভূত বাধাগুলি কিভাবে সরিয়ে ফেলা
হয়... সত্যজিৎ ধারণা প্রকাশের চাইতে আবেগী অভিজ্ঞতার যোগাযোগ স্থাপনেই বেশী আগ্রহী।
রুথ প্রোয়ের জাহাভ্লা, চিত্রনাট্যকার/লেখক
তাঁর অনেক কাজের মধ্যে, আমার
ব্যক্তিগত পছন্দ হচ্ছে চারুলতা। যদিও তিনি ছিলেন একজন অসাধারণ ভিজ্যুয়াল আর্টিস্ট,
কিন্তু সত্যজিৎ এর মূল প্রেরণা ছিল সাহিত্য। তিনি নিজের চিত্রনাট্য নিজেই লিখতেন(পরিচালনা
করতেন এমনকি মিউজিক কম্পোজ পর্যন্ত!) এবং তাঁর বিখ্যাত চলচ্চিত্রগুলো সবগুলোই ছিল পছন্দের
কোন উপন্যাস অথবা গল্পের থেকে নির্মিত, চারুলতা সহ, যেটা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি
উপন্যাসের উপর ভিত্তি করে তৈরি। মাধ্যমটি কোন ব্যাপার নয় — উপন্যাস, নাটক, চলচ্চিত্র,
মিউজিক — সবচেয়ে ক্ষমতাশালী প্রভাবটিই আমাদের কাছে পৌঁছায়। সকল বিখ্যাত কাজ অনুপ্রেরণা
দেয় একটি আশাবাদী প্রতিযোগিতার যেটা হয়ত অনেক সময় শেষ হয়, সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্রগুলোর
মত, উজ্জল সাফল্য — যেটা নিশ্চিত করে প্রভাব এবং অনুপ্রেরণার ধারাবাহিকতা যেটা আমাদের
চেষ্টা করতে এবং পুর্নবার চেষ্টা করতে সাহস যোগায়।
অরিন্দম গুস্তাভো বিশ্বাস
০২ মে ২০১৩
ঢাকা